সিন্ডিকেটের গ্যাঁড়াকলে গণপরিবহন
দেশে পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা দূর করা যায়নি কখনও। কারণ সিন্ডিকেটের ইচ্ছায় চলে এ খাত। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে, এই সিন্ডিকেট তাদের সঙ্গে মিশে যায়। ফলে কোনো সরকারের পক্ষেই এ সিন্ডিকেটের লাগাম টানা সম্ভব হয়নি। সাধারণ যাত্রীদের মতো সরকারও যেন জিম্মি হয়ে থাকে এই শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কাছে। বাস-মিনিবাস কিংবা ট্রাক-পিকাপ-কাভার্ডভ্যান- সবই চলে সিন্ডিকেটের ইশারায়। এদিকে গণপরিবহন সংকটের কারণে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা। পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা আছে নামে। সেখানে শুধু দায়িত্বের হাতবদল হয়। রাজনৈতিক বাধায় ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ অকার্যকর হয়ে যায়।
যত্রতত্র যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতা কমাতে নেওয়া উদ্যোগ ‘ঢাকা নগরপরিবহন’ এখন বন্ধ। বিআরটিসির সাহায্যে দুটি বেসরকারি কোম্পানি সেবাটি চালু করলেও লোকসানের কারণে বন্ধ। বাস মালিককদের দাবি ছিলÑ সরকারিভাবে চলমান বাসগুলো কিনে নেওয়া এবং নতুন বাস কেনার জন্য ব্যাংক ঋণ দেওয়া। রাজনৈতিক বাধায় এর কোনোটিই হয়নি। ফলে এক রুটে একটি গাড়ি চলবে এমন উদ্যোগটি ভেস্তে যায়।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত ঢাকা নগরপরিবহনের প্রথম বাসসেবা চালু হয়েছিল। পরে আরও দুটি রুটে এটি চালু হয়। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) বাস রুট রেশনালাইজেশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ৯টি ক্লাস্টার (৯টি ভিন্ন ভিন্ন রঙের), ২২টি কোম্পানি ও ৪২টি রুটের প্রস্তাব দেয়। এর মধ্যে আরবান ক্লাস্টার (নগর পরিবহন) ৬টি (রুট ৩৪টি) ও সাব-আরবান (শহরতলি পরিবহন) ক্লাস্টার ৩টি (রুট ৮টি)।
গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনা এখন সময়ের দাবি বলে মন্তব্য করে ডিটিসিএর নির্বাহী পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) নীলিমা আখতার বলেন, ঢাকা শহরের শৃঙ্খলাবদ্ধ পরিবহনের সূচনা করতে ডিটিসিএ দৃঢ়সংকল্প।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানীতে এমন অনেক বাসমালিক আছেন, যিনি ঋণ নিয়ে কোনো একটি বিদ্যমান কোম্পানিতে বাস নামান। বহু মালিকপ্রথার কারণে যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতা ও রেষারেষি থাকে। কয়েকটি বড় কোম্পানির অধীনে বাস চললে এ প্রতিযোগিতা হতো না।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
এ ছাড়া বাসের চালক, হেলপার কিংবা কনডাক্টররা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করেন। তাদের নিয়োগপত্রও নেই। মাসিক কোনো বেতন নেই। এটিও বিশৃঙ্খলার অন্যততম কারণ।
টিআইবির হিসাবে দেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস ও মিনিবাস থেকে বছরে এক হাজার ৫৯ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হয়। চাঁদার ভাগ পায় দলীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ, বিআরটিএর কর্মকর্তা-কর্মচারী, মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা।
গবেষণায় উঠে এসেছে- দেশের বৃহৎ বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশ পরিচালনার সঙ্গে রাজনীতিবিদরা সম্পৃক্ত। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত। এদিকে যাত্রীদের ৬০ দশমিক ৫ শতাংশ অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছেন।
জানা গেছে, মাছ ও তরকারি ব্যবসায়ীরা আড়ত থেকে পণ্য কিনে পরিবহনে ওঠানোর আগেই সেখানে চাঁদা দিতে হয়। কাভার্ডভ্যান, পিকআপ, সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকদের নিয়মিত চাঁদা দিতে হয় ঘাটে ঘাটে। এ ছাড়া বিভিন্ন লেগুনা স্ট্যান্ডে চাঁদা দিতে হয়। কল্যাণপুর, রাজারবাগ, সায়েদাবাদ, মহাখালী, পল্লবী, গুলিস্তান, যাত্রবাড়ী, গাবতলী এলাকাতেও চলে চাঁদাবাজি। ঢাকাসহ সারাদেশে নতুন বাস-মিনিবাস নামানোর ক্ষেত্রে প্রধান বাধা মালিক সমিতিগুলোর চাঁদাবাজি। বাস নামানোর আগেই মালিক সমিতির সদস্যপদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দুই থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বাস-মিনিবাস না নামার এটি অন্যতম কারণ। এ চাঁদা আদায়ে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোরও সমর্থন থাকে। মালিক সমিতি নতুন বাস নামানোর ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে আট লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেয় বলে মালিকদের সূত্রে জানা গেছে। আর মালিক সমিতিগুলো নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
মহানগরগুলোতে বাস চলাচলের অনুমতি (রুট পারমিট) দেয় পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বাধীন পরিবহন কমিটি। জেলায় কমিটি হয় পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে। আন্তঃজেলা পরিবহনের চলাচলের অনুমোদন দেয় বিআরটিএর সদর কার্যালয়। সব কমিটিতেই মালিক-শ্রমিকের প্রতিনিধি থাকেন। বিআরটিএর প্রতিনিধি কমিটির সদস্যসচিব ও সংস্থাটি নথিপত্র সংরক্ষণ করে। এ সুযোগে পরিবহন নেতারা চাঁদাবাজি করতে পারেন। গবেষণায় দেখা যায়, ৪০.৯ শতাংশ বাসকর্মী ও শ্রমিকদের মতে, সংশ্লিষ্ট কোম্পানির এক বা একাধিক বাসের নিবন্ধনসহ কোনো না কোনো সনদের ঘাটতি আছে।
ডিটিসিএ ও বিআরটিএ সূত্র জানায়, গণপরিবহনের একমাত্র সমাধান মেট্রোরেল নয়। সব রুটে কিংবা সব গন্তব্যে মেট্রো চলবে না। এমআরটি, বিআরটি কিংবা ফ্লাইওভার নির্মাণকেই একমাত্র সমাধান দেখিয়ে প্রকল্প বানাতে ব্যস্ত কর্মকর্তারা। শহরের রাস্তা বৃদ্ধিতে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি তাদের। অথচ রাজধানীর আয়তনের তুলনায় ২৫ শতাংশ সড়ক থাকার কথা। আছে মাত্র ৯ শতাংশ।
বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব পালন করেন আমলারা। ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলে পরিবহন নেতারা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেন। রাজধানীতে সচল রুটে বেসরকারি বাসের রুট পারমিট রয়েছে ৪ হাজার ৪৪৮টির। এর মধ্যে বাস ৪৩৯১টি ও মিনিবাস ৫৭টি। তবে অনুমতি আছে ৬৯৫৫টির।
রুট পারমিটের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিআরটিএ সদর কার্যালয়ের অধীনে ৩৯১টি দূরপাল্লার রুটের অনুমতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে ঢাকার ১০৬, চট্টগ্রাম মহানগরের ১৭, ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয় ৩৪, চট্টগ্রাম ৩০, রাজশাহী ৮, খুলনা ৯, বরিশাল ৯ ও রংপুর বিভাগীয় কার্যালয় ৫ এবং সকল জেলা থেকে ৬৯০টি রুট রয়েছে। গণপরিবহনের দুর্বলতায় ব্যক্তিগত গাড়িই নামছে বেশি। প্রতিদিন দেশের সড়কে নতুন করে নামছে এক হাজার ৪০৯টি মোটরসাইকেল, ৫০টি প্রাইভেটকার আর ১০টি করে বাস। প্রাইভেটকারের আধিক্য ঢাকার রাস্তায় যানজটের অন্যতম কারণ।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাইভেট গাড়ি নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে সড়কের সীমাবদ্ধতা ও পরিমাণ বিবেচনা করা উচিত। ২০০৪ সালে ঢাকার জন্য করা ২০ বছরের পরিবহন পরিকল্পনায় ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ বা ‘বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ’ চালুর পরামর্শ দেওয়া হয়। বিশেষ এ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল ঢাকার সড়ক থেকে লক্কড়ঝক্কড় বাস তুলে নেওয়া। সহজ শর্তের ঋণে নতুন বাস নামানো। বাস চলবে পাঁচ-ছয়টি কোম্পানির অধীন। মালিকরা বিনিয়োগের হার অনুসারে লভ্যাংশ পাবেন। বেসরকারি বাসমালিকরা প্রস্তাব দিয়েছিলেনÑ তাদের বাস কিনে নিতে। রাজনৈতিক বাধায় তা আর হয়ে ওঠেনি। পরে উদ্যোগটি ভেস্তে যায়।