নতুন বছরের শিক্ষাব্যয়ে উদ্বেগে অভিভাবকরা

এমএইচ রবিন
০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
নতুন বছরের শিক্ষাব্যয়ে উদ্বেগে অভিভাবকরা

উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে মানুষের জীবনমান কমে যায়। এর মধ্যে মাসের পর মাস ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অংকের উপরে রয়েছে। এ অবস্থায় শিশু-কিশোরদের পুষ্টিকর খাবার জোগান দেওয়া যেখানে কঠিন, সেখানে অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির কারণে শিক্ষা উপকরণের ব্যয় মেটানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে স্বল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের অভিভাবকদের পক্ষে। নিত্যপণ্যের দৈনন্দিন চাহিদার সঙ্গে সন্তানের লেখাপড়ার ব্যয় মিটাতে দিশাহারা অবস্থা তাদের। খাদ্য ও নিত্যপণ্যের চড়া মূল্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিক্ষাসামগ্রীর দাম বাড়ায় নতুন বছরে বর্ধিত শিক্ষাব্যয় নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা।

অভিভাবকরা বলেছেন, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের বিস্তর ফরাক তৈরি হয়েছে। ব্যয় নিয়ে বিপাকে। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে শিক্ষা উপকরণের উচ্চমূল্য। লেখাপড়া ব্যয় না চালাতে পেরে নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে। মধ্যবিত্ত পরিবারও শিক্ষাব্যয় কমাতে গিয়ে সন্তানের শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে চিন্তিত।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আমদানিনির্ভর পণ্যের দাম নির্ভর করে ডলারের মূল্যের ওপর। আবার মূল্যস্ফীতির কারণে খাদ্যের বা নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার বিষয়টি যেভাবে আলোচনায় আসে, শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ার বিষয় সেভাবে আলোচনায় আসে না। অথচ শিক্ষা উপকরণের দামের ঊর্ধ্বগতি ও আর্থিক টানাপড়েনে স্কুলে ঝরে পড়া এবং বাল্যবিয়ে বেড়ে যেতে পারে। সরকারের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) পর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিসি) অর্জনেও এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারকে যথাযথ উদ্যোগ এখুনি নিতে হবে।

রাজধানীর বাংলাবাজার নর্থব্রুক হল রোডের মুদি দোকানি ফারুক হোসাইন আমাদের সময়কে বলেন, তার তিন সন্তানের লেখাপড়ার জন্য চলতি বছরের শুরুতে ব্যয় করেছিলেন প্রায় ১০ হাজার টাকা। এখন নতুন বছরের ভর্তির জন্য তিন সন্তানের পেছনে ব্যয় হবে আবেদন থেকে ভর্তি পর্যন্ত ৩০ হাজার টাকা। এ ছাড়া স্কুল ড্রেস, জুতা, ব্যাগ, খাতা, কলমসহ ইত্যাদি লাগবে। এর জন্য তিন সন্তানের জন্য যে টাকা লাগবে তার জোগান নেই। দোকানের আয় দিয়ে তার বাসাভাড়া দেওয়ার পর কোনো রকম পরিবারের ব্যয় মিটাতে পারেন। এরপর এক মাসে বাড়তি টাকা ব্যয় করতে হলে তাকে দোকানের চালান (বিনিয়োগ পুঁজি) ব্যয় করতে হবে। অথবা তাকে ঋণ করতে হবে বলে অসহায় প্রকাশ করেন।

ফারুক হোসাইন ভাষ্য, গত বছর বাচ্চাদের যে স্কুল ড্রেস বানিয়েছেন প্রতিটি ড্রেসে তার ব্যয় ছিল তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। নতুন বছরে তা পাঁচ হাজারে ঠেকবে। স্কুলব্যাগ পুরনো হওয়ায় দুইজনের জন্য দুইটি ব্যাগ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বড় মেয়েকে পুরনো ব্যাগ দিয়ে আপাতত স্কুলে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন। দুই সন্তানের জন্য দুইটি ব্যাগ কিনতে তার লাগবে তিন থেকে চার হাজার টাকা, যা গত বছরও নিয়েছেন দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। একইভাবে জুতার দামও বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। বছরে দুই জোড়া করে জুতা দিতে হয় জানিয়ে ফারুক হোসাইন বলেন, এবার সাধারণ মানের সাদা একজোড় কেডস কিনতে লাগছে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা। গত বছর তিনি প্রতি জোড়া জুতা কিনেছিলেন আটশো থেকে এক হাজার টাকায়।

বই-খাতা-কলমের পাশাপাশি শিক্ষার জন্য অপরিহার্য অনেকগুলো উপকরণ। পেনসিল, শার্পনার, ইরেজার, মার্কার, স্ট্যাপলার, পিন, ক্লিপ, অফিস ফাইল, ক্যালকুলেটর, কলমের বক্স, স্টিল ও প্লাস্টিক স্কেল, রং পেন্সিল, কাঁচি, আইকা, পরীক্ষায় ব্যবহৃত হয় এমন ক্লিপবোর্ড ইত্যাদি। এ ছাড়া, শিক্ষার্থীদের নানান প্রয়োজনে ফটোকপি করতে হয়। প্রতি পৃষ্ঠার ফটোকপির জন্য তিন থেকে পাঁচ টাকা ব্যয় করতে হয় এখন। প্রিন্ট করতে করতে পৃষ্ঠাপ্রতি ৫-১০ টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গেল প্রায় ছয় মাসে কয়েক ধাপে বই ও খাতার কাগজসহ সব ধরনের শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়েছে দেড় থেকে দুই গুণ পর্যন্ত। এর ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত অভিভাবকরা পড়েছেন সংকটে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী ফারজানা আক্তার জুঁই বলেন, চার মাস আগেও মেয়ের জন্য ফকিরাপুল থেকে হাফ রিম কাগজ কিনেছিলেন সাড়ে তিনশ টাকায়। গত সপ্তাহে কাগজ শেষ হলে আবার কাগজ কিনতে গেলে দোকানি দাম চাচ্ছেন সাড়ে পাঁচশ টাকা। পরে যাচাই করতে কয়েকটি দোকানে গেলে একই দাম চান অন্য বিক্রেতারাও। বাজারে সবকিছুর দাম বেড়েছে, তাই বলে কাগজের দামটাও এভাবে বাড়বে? পড়াশোনার যে খরচ বাড়বে, সে অনুপাতে বেতন বাড়বে না। এখন সন্তানদের লেখাপড়ার বাড়তি খরচ নিয়ে চিন্তায় আছি।

আরেক অভিভাবক মৌসুমি আক্তার বলেন, আমাদের তো নির্দিষ্ট বেতনের চাকরি। এ দিয়ে সংসারের খরচের পর সন্তানদের পড়ালেখা টাকা জোগাড় করতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অস্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলের জন্য গেল বছর ক্যাসিও সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর কিনেছিলেন ১ হাজার টাকায়। হারিয়ে যাওয়া আবার একটি ক্যালকুলেটর কিনছেন এখন ১ হাজার ৭০০ টাকায়। দোকানি জানিয়েছেন আমদানি বন্ধ বাজারে ক্যালকুলেটর নেই।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক শাহ মাহদুল হাসান বলেন, খরচ বেড়ে গেলে সংসারে টান পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। মূল্যস্ফীতির কারণে খাদ্যের বা নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার বিষয়টি যেভাবে আলোচনায় আসে, শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ার বিষয় সেভাবে আলোচনায় আসে না। শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ার কারণে অভিভাকদের খরচের বোঝা আরও ভারী হয়ে যাবে।

আর্থিক টানাপড়েনে স্কুলে ঝরে পড়া এবং বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সরকারের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) পর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিসি) অর্জনে এর প্রভাব দেখা দেবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারকে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ তার।

স্টেশনারি ব্যবসায়ী চকবাজারের সুগন্ধা ট্রেডাসের ম্যানেজার সায়মুন জানান, প্রয়োজনের তুলনা আমদানি কম। ডলার সংকটের কারণে কাগজসহ সব ধরনের স্টেশনারির দাম বেড়েছে। তিনি বলেন, আমরা কিনে বিক্রি করি সামান্য ব্যবসা হয়। যারা ইমপোর্ট করেন তারাই ভালো বলতে পারবেন আসলে মূল্য কতটা বেড়েছে। এখন বাজারে সরবরাহ কম।

চকবাজার, বাংলাবাজার, রামপুরা, মতিঝিলের খুচরা দোকানিদের তথ্যানুযায়ী, ৮ টাকার এক দিস্তা কাগজে দাম বেড়ে ১৫ থেকে ২০ টাকা এবং ১২ টাকা থেকে দাম বেড়ে ২০-২৪ টাকা হয়েছে। কলমের ডজনে বেড়েছে ৫-৭ টাকা পর্যন্ত। ৬৮-৭২ টাকা ডজনের পেনসিলের দাম বেড়ে হয়েছে ১০০ টাকা। প্রতিটি ইরেজারে দাম বেড়েছে ৩-৫ টাকা পর্যন্ত। রংপেন্সিলের দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত। প্লাস্টিক বোর্ডের দাম বেড়েছে দিগুণ। জ্যামিতি বক্স ৬০-৮০ টাকা থেকে বেড়ে ১৫০-২০০ টাকা। এ ফোর সাইজের কাগজে প্যাকেট প্রতি বেড়েছে এক থেকে ১৫০ টাকা। মাত্র পাঁচ-ছয় মাসের ব্যবধানে এসব উপকরণের দাম ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত এবং কোনো কোনো উপকরণে দাম শতভাগ দ্বিগুণ বেড়েছে।