তারেক রহমানসহ সব আসামি খালাস

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক
০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
তারেক রহমানসহ সব আসামি খালাস

২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ সব আসামিকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ডেথ রেফারেন্স নাকচ করে এবং আসামিদের আপিল মঞ্জুর করে গতকাল রবিবার বিচারপতি একেএম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, মুফতি আব্দুল হান্নানের জবানবন্দির ভিত্তিতে যে সম্পূরক অভিযোগপত্রে এ মামলার বিচার শুরু হয়েছিল, সেই অভিযোগপত্রই ছিল অবৈধ। মামলাগুলোর বিচারিক আদালতের রায় অবৈধ, কারণ তা অবৈধ উপায়ে দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, এ মামলায় বিচারিক আদালত ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছিলেন।

হাইকোর্টের রায়ের পর আসামিপক্ষের আইনজীবী জয়নুল আবদিন জানান, এখানে মূল বিষয়টি আরম্ভ হয়েছে জনসভার পারমিশন নিয়ে। সরকার জনসভার অনুমতি দিয়েছিল পাশের একটি মাঠে। পরবর্তী পর্যায়ে সরকারকে না জানিয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী (শেখ হাসিনা) ওই স্থান পরিবর্তন করে এ রাস্তার মধ্যে নিয়ে আসেন। এটা ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সরকারি দলকে বেকায়দায় ফেলতে তিনি এ কাজ করেছিলেন। সে জন্যই আমাদের বিশ্বাস, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ গ্রেনেড হামলাটা তখন হয়েছিল। তিনি বলেন, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় চার্জশিটে তারেক রহমানের নাম কোথাও ছিল না। সাবসিকোয়েন্টলি আব্দুল কাহার আকন্দকে দিয়ে এ মামলার মধ্যে তারেক রহমানকে সম্পৃক্ত করা হয়। তাকে সম্পৃক্ত করে এ মামলায় সাজা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

জয়নুল আবদীন বলেন, আদালত সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করেছেন। দেখেছেনÑ যে সাক্ষ্যে, যে চার্জশিটে তাদের সাজা দেওয়া হয়েছে, এমনকি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, এ মৃত্যুদণ্ড টিকতে পারে না। ডাইরেক্ট কোনো এভিডেন্স না থাকলে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না, সেখানে আজীবন সাজাও দেওয়া যায় না। তিনি বলেন, সমস্ত দিক বিচার-বিশ্লেষণ করে আদালত মনে করেছেন, এ মামলায় যারা আপিল করেছেন এবং যারা আপিল করতে পারেননি, প্রত্যেককেই খালাস দেওয়া প্রয়োজন। মামলাটিকে সারা বছর আওয়ামী লীগ সরকার ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। তারা চেয়েছিল তারেক রহমানকে মামলা দিয়ে চিরজীবন তাকে বাইরে রাখবে এবং এমনকি তাকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আদালত এ রকম কোনো এভিডেন্স পায়নি যে, তারেক রহমানকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন। আজ (গতকাল) হাইকোর্টের এই রায়ের মাধ্যমে সবাই খালাস পেলেন।

আদালতে লুৎফুজ্জামান বাবর, আবদুস সালাম পিন্টুসহ বেশ কয়েকজন আসামির পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এসএম শাহজাহান। রায়ের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তারা হাইকোর্টের প্রতি কৃতজ্ঞ। ন্যায়বিচার পেয়েছেন। এই রায়কে তারা সাধুবাদ জানান। সাক্ষ্য ও আইন, কোনো দিক দিয়েই এ মামলা প্রমাণিত হয়নি।

রায়ের পর তিন আসামির আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির বলেন, বিচারিক আদালতের রায়ে ৪৯ জনকে সাজা দেওয়া হয়েছিল। ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৯ জনকে যাবজ্জীবন এবং বাকি ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সবার আপিল মঞ্জুর করেছেন হাইকোর্ট। রুল যথাযথ ঘোষণা করেছেন। সবাইকে মামলা থেকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

শিশির মনির বলেন, বিচারিক আদালতের আগের বিচারটা অবৈধ বলা হয়েছে হাইকোর্টের রায়ে। আইনের ভিত্তিতে বিচারিক আদালতের বিচারটা হয়নি। এক সাক্ষীর সঙ্গে অন্য সাক্ষীর বক্তব্যে মিল নেই। শোনা সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করে রায় দেওয়া হয়েছে। আপিল মঞ্জুর করে ডেথ রেফারেন্স খারিজ করে সবাইকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট।

শিশির মনির আরও বলেন, তারেক রহমান, বাবরসহ সবাইকে এই মামলা থেকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ ধরনের মামলায় পরস্পর কেউ স্বচক্ষে দেখেছেন- এ মর্মে কোনো এভিডেন্স (প্রমাণ) নেই। যাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে, তা নির্যাতনের মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে। মুফতি হান্নান দুটি জবানবন্দি দিয়েছেন। দ্বিতীয় স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে সাজা দেওয়ার নজির নেই। এই স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করেন তিনি। এ জন্য এর আইনগত মূল্য নেই। দ্বিতীয় অভিযোগপত্র দায়রা আদালতে দাখিল করা হয়। দায়রা আদালত এটি আমলে নিয়েছেন। আইন অনুযায়ী তিনি (দায়রা আদালত) এটা করতে পারেন না। এ জন্য এই অভিযোগ আমলে নেওয়ার ভিত্তিতে যে সাজা দেওয়া হয়েছে, তাকে অবৈধ বলেছেন হাইকোর্ট।

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না, জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, রায়ের কারণ দেখে ও নির্দেশনা নিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আপিল করা উচিত বলে মনে করি।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মতিঝিল থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি মামলা হয়। ওই হামলা ও হত্যাযজ্ঞের তদন্তকে ভিন্ন খাতে নিতে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার নানা তৎপরতা চালায় বলে অভিযোগ ওঠে। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ-সংক্রান্ত মামলা দুটির (হত্যা ও বিস্ফোরক) তদন্ত নতুনভাবে শুরু করে। ২০০৮ সালে ২২ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এতে বলা হয়Ñ শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে ওই হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। পরে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে মামলার অধিকতর তদন্ত হয়। এরপর তারেক রহমানসহ ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর তৎকালীন বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন এই মামলার রায় দিয়েছিলেন। দণ্ডিত ৪৯ জনের মধ্যে ১৯ জনের সাজা মৃত্যুদণ্ড, ১৯ জনের সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং বাকি ১১ জনের সাজা বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড। রায়ে মৃত্যুদণ্ডের দণ্ডিতদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু। এ ছাড়া রয়েছেন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীর (হুজি) নেতারা। রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত ১৯ জনের অন্যতম একজন তারেক রহমান। ২০০৮ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত তারেক রহমানকে পলাতক দেখিয়ে এই বিচার হয়েছিল। রায়ের পর ২০১৮ সালে বিচারিক আদালতের রায়সহ মামলা দুটির নথিপত্র হাইকোর্টে এসে পৌঁছায়। এটি সংশ্লিষ্ট শাখায় ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। গত ৩১ অক্টোবর ডেথ রেফারেন্স, আসামিদের আপিল ও জেল আপিলের ওপর হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়। ২১ নভেম্বর শুনানি গ্রহণ শেষে আদালত মামলা দুটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন। গতকাল রায় ঘোষণা করা হয়।

দণ্ডপ্রাপ্ত চার মামলার তিনটিতে তারেক রহমানের অব্যাহতি

দেড় দশক ধরে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকেই চলছে আলোচনা। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটার পর বিচারিক আদালতে বিভিন্ন মামলায় তাকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়েছে। বিএনপি আগে থেকেই দাবি করে আসছে, তারেকের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ আমলে করা এসব মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিগত ১৭ বছরে তার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে শতাধিক মামলা করা হয়েছিল। এসব মামলার মধ্যে চারটি মামলায় তার বিরুদ্ধে বিচারিক আদালতের দণ্ড ছিল। সম্প্রতি দণ্ডপ্রাপ্ত তিনটি মামলা থেকে তিনি অব্যাহতি পেলেও একটি মামলা ঝুলে আছে। সেটা হচ্ছে জিয়া অরফানেজ (এতিমখানা) ট্রাস্ট মামলা। এই মামলায় হাইকোর্টের রায়ও হয়েছে। এর বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার আপিল এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন। এ ছাড়া রাষ্ট্রদ্রোহ, মানহানিসহ নানা অভিযোগে শতাধিক মামলা রয়েছে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে। তবে সেগুলোর কোনোটি রায়ের পর্যায়ে যায়নি।

আইনি সব বাধা কাটিয়েই দেশে ফিরতে চান তারেক রহমান। এমনটাই বলছিলেন বিএনপির নেতারা। একের পর পর এক মামলায় অব্যাহতি পাওয়া দৃশ্যত তারেকের দেশে ফেরা এগিয়ে আনছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, চিকিৎসার জন্য তার দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যখন বিদেশ যাবেন, তখনই দেশে ফিরবেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক।

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বলেন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য ট্রায়ালটা কনটিনিউ করা হয়। তারেক রহমান সাহেব আজকের এ রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পেয়েছেন।