প্ল্যাটফর্ম নয়, চিন্তার ঐক্য চান রাজনৈতিক নেতারা
দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিজেদের সচেতন থাকা এবং দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবিলার জন্য গত কয়েক দিন ধরে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করছেন রাজনৈতিক দলগুলো নেতারা। এই প্রেক্ষাপটে কয়েকটি দলের নেতারা বলেছেন, অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে জাতীয় ঐক্যটা গড়ে উঠেছিল, ১০০ দিন পরে মনে হচ্ছে, সে ঐক্যের মধ্যে কিছুটা ফাটল, কিছুটা বিভাজন তৈরি হয়েছে, সেটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার। যদি আন্দোলনের দলগুলোর, অভ্যুত্থানের পক্ষের দলগুলোর মধ্যে এ রকম বিভাজন থাকে, তাহলে আমাদের গণতন্ত্রে উত্তরণটা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এ কারণে নেতারা মনে করেন, ঐক্যের জন্য নতুন কোনো প্ল্যাটফর্ম সৃষ্টি নয়, চিন্তা বা বোঝাপড়ার ঐকমত্য হতে পারে। এই ঐক্য সৃষ্টির জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আহ্বান আসতে পারে, আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেও হতে পারে। তাদের মতে, ঐক্য ছাড়া গণ-অভ্যুত্থানের সুফল মিলবে না।
প্রধান উপদেষ্টার বাস ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐক্য গঠনের কথা বলেছেন। সেদিন তিনি বলেন, ‘আমাদের সামনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য, বিশেষ করে যারা বাংলাদেশে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় অথবা স্ট্যাবিলিটি বিনষ্ট করতে চায়, তাদের প্রতিহত ও প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের অবশ্যই জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।’
দেশের বৃহত্তর স্বার্থে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার কাছে বিএনপি যে দাবি জানিয়েছে, তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। গত বৃহস্পতিবার দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যের কথা অবশ্যই এসেছে। উদ্বেগ নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করেছি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে শান্তিশৃঙ্খলা কারা বিঘ্নিত করছে সেটি চিহ্নিত করতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে মোকাবিলা করতে হবে।’
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
প্রধান দুটি দলের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্যের কথা উচ্চারিত হওয়ার পর গত কয়েক দিন ধরে রাজনীতিতে এ নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ডাকসুর সাবেক ভিপি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব আমাদের সময়কে বলেন, ‘জাতীয় ঐক্য হবে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনীতি শক্তির। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে জড়িত রাজনৈতিক দল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ সব সমাজ ও শক্তির সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। আগে জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা বা অনিবার্যতা অনুভব হোক, তারপর প্রশ্ন আসবে প্ল্যাটফর্ম হবে কি না।’
গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক আমাদের সময়কে বলেন, ঐক্যের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় সংলাপের আয়োজন করতে পারে। আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বিত উদ্যোগও এখানে থাকতে পারে। এর মধ্য দিয়ে নতুন কোনো প্ল্যাটফর্ম তৈরি নয়, চিন্তার ঐক্য বাড়িয়ে তোলা, বোঝাপড়া বৃদ্ধি করা, ন্যূনতম জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে ঐকমত্যের জায়গাটা বাড়িয়ে তোলা যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধ আছে, আদর্শিক বিরোধ আছে; কিন্তু অভ্যুত্থানের স্বার্থরক্ষা, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ এসব বিষয়ে আমাদের মধ্যে কোনো বিরোধ বা ভিন্নতা নেই। এসব প্রশ্নে ঐকমত্য থাকা দরকার। জাতিকে এই বার্তাটা দেওয়া যে, আমরা অভ্যুত্থানের স্বার্থ ও তার সাফল্য ধরে রাখতে চাই এবং এই কাজগুলোর মধ্য দিয়ে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উত্তরণের দিকে যাব।’
ঐক্যের পথে প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে সাইফুল হক বলেন, ‘জাতীয় ঐক্য সৃষ্টিতে কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। আমরা এখন পর্যন্ত সরকারকে পুরোপুরি অ্যাক্টিভ দেখছি না। তাদের মধ্যে এক ধরনের নিস্পৃহ মনোভাব লক্ষ করেছি। যে কোনো একটি অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের যে গতি-উদ্যোগ থাকা দরকার এবং তাদের যে আস্থা নিয়ে কাজ করা দরকার, যে দৃঢ়তা থাকা দরকার, এসব আমরা দেখছি না। এই সরকার একটা দুর্বল সরকার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তা ছাড়া রাজনৈতিক দলসহ সমাজের নানা গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনের সঙ্গে সরকারের এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা বা দূরত্বের জায়গা আছে। সরকারকে উদ্যোগ নিয়ে এটা কাটিয়ে ওঠা দরকার।’
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের আলোকে আমাদের সময়কে বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে ও প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে সে ঐক্য আবার ভেঙেও গেছে। ইতিহাসে এ পর্যন্ত আমরা দুই ধরনের ঐক্য দেখেছি। একটা হলো আন্দোলনের ঐক্য অর্থাৎ সরকার পতনের ১ দফা দাবিতে জাতীয় ঐক্য। আরেকটি হলো নির্বাচনী ঐক্য। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমরা ডান-বাম জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ঐক্যের কথা বলতে পারি। আবার ৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং এবারের ২৪-এর জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে আমরা রাজপথে অভূতপূর্ব গণঐক্য দেখেছি।’
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
এই ঐক্যবদ্ধতা আপাতত প্ল্যাটফর্ম আকারে নয়- এমন উল্লেখ করে মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘যে কোনো ঐক্যের পর স্বার্থকে কেন্দ্র করে সাধারণত ঐক্যে ফাটল দেখা দেয়। কার কী অবদান নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। গত তিন মাসে সে রকম আভাস আমরা দেখতে পাচ্ছি। এখন আমরা কী আগে সংস্কার করব, না নির্বাচন! অথবা কার কী অবদান বা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি এই আলোচনা করে ঐক্য ভেঙে দেব? নাকি সবাই মিলে রক্ত দিয়ে বিজয় অর্জন করেছি, এখন ঐক্যবদ্ধভাবে বিজয়ের সুফল হিসেবে একটি কমন ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও একটি অবাধ, গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করে টেকসই গণতন্ত্র চর্চায় নিয়োজিত হব? সে প্রশ্ন সামনে এসেছে। আমরা আপাতত প্ল্যাটফর্ম আকারে না ভেবে একটি কমন ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরের মাধ্যমে ২৪-এর গণবিপ্লবের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সবার ঐক্যবদ্ধ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের পক্ষে।’