নানামুখী যন্ত্রণায় মানুষ
দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতিতে নিম্নআয়ের মানুষ তো বটেই, মধ্যবিত্তদের যাপিত জীবনও দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। রাস্তায় নামলেই ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার ভয় মানুষকে তাড়া করছে। চুরি-ডাকাতি নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তায় নামলেই পোহাতে হচ্ছে যানজটের ভোগান্তি। এর মধ্যে দুই সিটি করপোরেশনের উদাসীনতায় প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা। হাসপাতালে বাড়ছে আক্রান্ত রোগীর ভিড়। সরকারি হিসাবেই যা ইতোমধ্যে ৯০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বায়ুদূষণও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে; নগরবাসীর শরীরে বাসা বাঁধছে নানান রোগ-ব্যাধি। এর মধ্যেই শুরু হতে যাচ্ছে নতুন বছর। এরই মধ্যে অনেক বাড়িওয়ালা ভাড়া বৃদ্ধির নোটিশ দেওয়া শুরু করেছে। এ নিয়েও রয়েছে দুশ্চিন্তা। এত সব যন্ত্রণার চাপে পিষ্ট এখন রাজধানী ঢাকার কোটি মানুষ।
গতকাল ঢাকার কারওয়ানবাজারে কেনাকাটা করতে আসা লিয়াকত আলী নামে এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী বলেন, বছর কয়েক আগেও ৫০০ টাকা বাজার করলে সদাই টানতে কুলি লাগত। এখন হাজার টাকার বাজারও পলিথিনে ভরে নিয়ে যাওয়া যায়। সাধারণ মানুষের আয় না বাড়লেও ব্যয় কয়েকগুণ বেড়েছে। পাঁচজনের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমন দশা শুধু লিয়াকত আলীর নয়, সব নগরবাসীরই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালা বদলের পর ঢাকার রাজপথসহ বিভিন্ন স্থানে ধারাবাহিক আন্দোলন ও সহিংসতার ঘটনায় ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে অনিশ্চয়তা কমছে না। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ গেট এলাকার চটপটি বিক্রেতা স্বপন আমাদের সময়কে বলেন, ৫-৬ মাস আগেও তিনি প্রতিদিন যত টাকার চটপটি বিক্রি করতেন সাম্প্রতিক সময়ে তার অর্ধেকও পারছেন না। কারণ আগের তুলনায় ক্রেতা কম। তার ওপর সবজির দাম বাড়তি থাকায় আগের চেয়ে তার কম লাভ হচ্ছে। শুধু স্বপনই নন, ঢাকার ফুটপাতের ব্যবসায়ীদেরও প্রায় একই মত। ক্রেতা কম, তাই আগের মতো ব্যবসা হচ্ছে না।
আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নগরবাসীকে ভাবাচ্ছে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই লেগেই আছে। এর মধ্যে ছিনতাই মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ঘর থেকে বেরিয়েই নিরাপত্তা নিয়ে মানুষকে ভয়ে থাকতে হচ্ছে। সঙ্গে থাকা নগদ টাকা, মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান মালামাল যে কোনো সময় ছিনতাই হয়ে যেতে পারেÑ এই দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়েই মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছতে হচ্ছে।
আলাউদ্দিন নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যের কারণে তিনি রাতে রিকশায় চলাচল
করতে চরম ভয় পাচ্ছেন না। যে কারণে কোনো কোনো দিন তিনি অফিস থেকে সিএনজি অটোরিকশায় বাসায় ফিরতে বাধ্য হয়েছেন।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের সময়কে বলেন, মাত্র দুদিন আগে রাত ৯টার দিকে তিনি কাকরাইল মোড়ে ছিনতাই হতে দেখেছেন। ঘটনাটি ঘটেছে রমনা থানার নাকের ডগায়। তিনি বলেন, পাশেই যে রমনা থানা এই ভীতিও কাজ করেনি ছিনতাইকারীদের মধ্যে।
ঢাকায় প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে মানুষ রাস্তায় নামছেন। অবরোধ করছেন সড়ক। এতে পথ-চলতি মানুষকে চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে। গত সপ্তাহে সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে তিন কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃষ্ট ঘটনা। ঢাকার যে কোনো একটি পয়েন্টে সড়ক অবরোধ হলেই তার রেশ পড়ছে পুরো শহরে। এতে গন্তব্যে পৌঁছতে মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
রাজধানীর নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্যই মাত্র কয়েক দিন আগেই ঢাকার পুলিশ কমিশনারকে সরিয়ে দেয় সরকার। নতুন কমিশনার নিয়োগ করা হয় শেখ মো. সাজ্জাত আলীকে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে তিনি বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। আমাদের সময়ের কাছে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন শিগগিরই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে উন্নতি হবে। সে অনুযায়ী ঢাকা মহানগর পুলিশ কাজ করছে বলেও জানান তিনি।
আর এক মাস পরই নতুন বছর শুরু হবে। বছর শেষ হওয়ার আগেই ইতোমধ্যে ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় বাড়িওয়ালারা বাসা ভাড়া বৃদ্ধির মৌখিক ও লিখিত নোটিশ করতে শুরু করেছে। এতে নতুন করে নগরবাসীর দুশ্চিন্তার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
আজিমপুরের গৃহবধূ কাকলী আক্তার আমাদের সময়কে বলেন, বছর শেষ হয়নি, কিন্তু এরই মধ্যে বাড়িওয়ালার পক্ষ থেকে দেড় হাজার টাকা ভাড়া বৃদ্ধি করার মৌখিক নোটিশ দেওয়া হয়েছে। চাকরিজীবীর স্বামীর আয় বাড়েনি। এর মধ্যে বাসা ভাড়া বাড়লে তা কীভাবে মেটাবেন, এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন আমাদের সময়কে বলেন, মানুষ অনেক দিন ধরেই সংসারের খরচ কাটছাঁট করে চালিয়েছে। সেই ধারা এখনও অব্যাহত আছে। সরকার পরিবর্তনের পর মানুষ আশা করেছিল, চাপ কিছুটা কমবে। কিন্তু প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে অন্যান্য খরচও বাড়ছে। বছর শেষে বাড়ি ভাড়াও বাড়তে পারে। মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে চিকিৎসা, লেখাপড়া ও যাতায়াতসহ অন্যান্য খরচও বাড়ছে। সেই অর্থে কিন্তু আয় বাড়ছে না। ফলে খাদ্যের তালিকা ছোট করতে হচ্ছে। খাদ্য কমে যাওয়ায় পুষ্টির ঘাটতি হয়ে মানুষ রোগাক্রান্ত হচ্ছে। কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এর প্রভাব জিডিপির ওপর পড়বে একটা সময়। এই অবস্থা যদি চলমান থাকলে জীবনমানের চরম অবনতি হবে।
শীতের আগমনের সঙ্গে ঢাকার দুই সিটিতেই মশার যন্ত্রণা মারাত্মকভাবে বেড়েছে। মশার যন্ত্রণায় রাতে ঠিকমতো ঘুমানোই দায় হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ভীতি মানুষকে তাড়া করছে। প্রতিদিনই ডেঙ্গুজ¦রে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার অসংখ্য মানুষকে হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। চলতি মাসে গতকাল পর্যন্ত এডিস মশাবাহিত রোগটিতে ১৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত এক মাসে সর্বোচ্চ মৃত্যু এটি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, বসবাসের জন্য ঢাকা পৃথিবীর অন্যতম খারাপ শহর। দূষণ থেকে যানজট খারাপ শহরের সব কিছুই আছে এখানে। যত দিন যাচ্ছে, শহরের পরিবেশ ততই খারাপ হচ্ছে। নতুন নতুন আবাসিক প্রকল্প, শিল্প ও ব্যবসাকেন্দ্র নির্মাণ করতে গিয়ে আমরা পরিবেশকে অগ্রাহ্য করেছি। এখানে নাগরিক পরিষেবা খুবই দুর্বল। এখন ঢাকার মানুষের যে প্রাণশক্তি আছে, সেটাই ঢাকাকে বাঁচিয়ে রাখবে। দূষণের কারণে মানুষ অসুস্থ হয়ে মারা যাচ্ছে, সেই সঙ্গে চিকিৎসার করতে গিয়ে পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। নদীর দূষণ বন্ধ করতে পারলে নদী জীবন্ত হয়ে উঠবে। হাউজিংয়ের জন্য ঢাকার আশপাশে বালু উত্তোলন এবং ইটভাটা বন্ধ করতে পারলে বায়ুদূষণও কমে যাবে। সব ধরনের চাপ ও প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে পরিকল্পিত উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারলে বসবাসের জন্য উপযোগী হয়ে গড়ে উঠবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৯০ হাজার ৭৯৪ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গত মাসে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩০ হাজার ৮৭৯ জন। চলতি মাসে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৮ হাজার ৯৭৭ জন। অপরদিকে এ বছর ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি ২০৫ রোগীর মৃত্যু হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার হাসপাতালে। এরপর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসাধীন মৃত্যু হয়েছে ৮৯ জনের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শীতের শুরুতেই ঢাকার বায়ুতে দূষিত বস্তুকণার পরিমাণ উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে। মেয়র ও কাউন্সিলরহীন নগরে রাস্তায় পানি ছিটানো হচ্ছে না। দূষণে দায়ী যানবাহন কিংবা ইটভাটা চলছে দেদার। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ঢাকার বায়ু শীতের শুরুতেই অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ফলে সামনে শীত বাড়লে দূষণের তীব্রতা আরও বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। বিশ্বজুড়ে বায়ুদূষণ পরিস্থিতির হালনাগাদ তথ্য তুলে ধরা সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের প্রতিবেদন বলছে, নভেম্বরজুড়ে দূষণে ঢাকা শীর্ষ দুই-তিনের মধ্যেই ছিল। গতকাল রাত ৮টায় ঢাকার বায়ুমানের স্কোর ছিল ১৮১। যা সারা পৃথিবীর মধ্যে তৃতীয়তম দূষিত শহর।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
বায়ুদূষণ রোধে নেওয়া পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. জিয়াউল হক বলেন, বায়ুদূষণ রোধে অধিদপ্তরের একার পক্ষে কিছু করার থাকে না। গাড়ি দূষণ বন্ধ করার এখতিয়ার বিআরটিএর। সিটি করপোরেশনের অনেক জায়গাতেই বর্জ্য পোড়ানো হয়, এগুলো বন্ধ করার দায়িত্ব ওই সংস্থার। আমরা তাগিদ দিচ্ছি, কিন্তু অন্য সংস্থা তা শুনছে না। তারপরও দূষণ রোধে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা বেশির ভাগই সর্দি-জ¦র ও শ্বাসকষ্টের রোগী। শীত আগমনে এসব রোগ বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। শান্তিনগর থেকে চিকিৎসা নিতে আসা নাজমা বেগম বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে পরিবারের সবার সর্দি-কাশি লেগেই আছেে। পরিবারের একজন সুস্থ হয়ে উঠলে আরেকজন আক্রান্ত হচ্ছে। সর্দিকাশির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে শ্বাসকষ্ট। কয়েকদিন ধরে জ¦র-কাশি সঙ্গে শ্বাসকষ্ট হওয়ায় ছয় বছর বয়সী মেয়েকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে এসেছেন।