শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে জনদুর্ভোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক
৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে জনদুর্ভোগ

সড়ক বন্ধ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া কিংবা যে কোনো ইস্যুতে সংঘর্ষে জড়ানো বর্তমানে প্রায় দেখা যাচ্ছে। আগস্টের ৫ তারিখে ফ্যাসিস্ট সরকার পদত্যাগ করলে দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। গত তিন মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে নানামুখী আন্দোলন। এর ফলে জনদুর্ভোগ তৈরি হয়েছে সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে।

এই সমস্যার সমাধান কোথায়? আমাদের সময়কে জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন তাদের মতামত অনুলিখন : রাকিবুল ইসলাম

সময় এসেছে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সমস্যাগুলো সমাধান করার

খায়রুল ইসলাম স্বাধীন

শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ

অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট সরকারের দমন-পীড়নের চাপা ক্ষোভ এখন নতুন করে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। বর্তমান সরকার যেহেতু ছাত্র-শ্রমিক-জনতার প্রতিনিধিত্ব করে তাদের কাছে দাবিসমূহ আদায়ের আন্দোলনের গ্রহণযোগ্যতা ও তীব্রতা স্বাভাবিকভাবেই বেশি।

ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ প্রকট।

উদাহরণস্বরূপ,

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে মাত্র একটি ছাত্রী হল। তাদের হলের দাবিতে আন্দোলন কোনোভাবেই অযৌক্তিক নয়। অন্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও নানা ধরনের সংকটে ভুগছে। সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে ভোগান্তির শিকার, যা তাদের রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী আবাসন সংকটসহ নানা সমস্যার মুখোমুখি। এই দুর্ভোগ ধীরে ধীরে পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়েছে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে শহরে অবরোধ সৃষ্টি হচ্ছে, যা নাগরিক জীবনে স্থবিরতা এনে দিয়েছে। উগ্র ও ক্ষুব্ধ কিছু শিক্ষার্থীর ভাঙচুর এবং ট্রেনে হামলার ঘটনায় নারী ও শিশুরা আহত হয়েছে। কিন্তু সরকার এখনও কোনো কার্যকর সমাধান দিতে ব্যর্থ। জনতার সরকার হয়ে উঠলেও, ক্রমেই তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। আন্দোলন দমাতে এখন লাঠিপেটা, টিয়ার গ্যাস, এমনকি স্থানীয় সন্ত্রাসীদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর ভয়াবহ হামলার ঘটনা এর প্রমাণ। এখন সময় এসেছে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার প্রতিনিধিরা জনতার মাঝে ফিরে এসে সমস্যাগুলোর যৌক্তিক সমাধান খুঁজে বের করার। জনদুর্ভোগ এখন দেশের অন্যতম প্রধান ইস্যুতে পরিণত হয়েছে, যা বর্তমান সরকারকে চাপে ফেলছে।


ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থনীতি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে

ঋতু পান্না

শিক্ষার্থী, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ

রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এর প্রভাব সাধারণ জনগণের ওপর অত্যন্ত নেতিবাচক। আন্দোলনকারীরা যেহেতু সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাই রাস্তাঘাট বন্ধ, যানবাহন চলাচল বাধাগ্রস্ত এবং শহরের বিভিন্ন এলাকা অবরুদ্ধ হয়ে যায়, যার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দোকানপাট বন্ধ হওয়া, পরিবহন সংকট এবং কর্মস্থলে উপস্থিতি কমে যাওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতি শ্রমজীবী মানুষের জন্য আরও কঠিন হয়ে উঠছে, যারা দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল। আন্দোলন যদি সহিংসতায় পরিণত হয়, তবে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা সংকট তৈরি হয়, যা আরও বড় বিপদ ডেকে আনে। স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য সরবরাহ এবং অন্যান্য জরুরি সেবা প্রদানেও সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। আন্দোলনের কারণে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে, ফলে রোগীরা সঠিক সময়ে চিকিৎসা পাচ্ছে না। শান্তিপূর্ণ সমাধান ছাড়া পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে, যা দেশের সার্বিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলবে।


আন্দোলনের নির্দিষ্ট সীমা ও সতর্কতা অবলম্বন করা

জিহাদ হোসেন

শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ

আন্দোলন যখন জনগণের ন্যায্য দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত হয়, তখন তা সমর্থনযোগ্য হতে পারে, তবে এর ফলে যে দৈনন্দিন জীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয় তা অস্বীকার করার মতো নয়। আন্দোলনের ফলে যে দুর্ভোগের সৃষ্টি হয় তা বিভিন্ন দিক থেকে পরিলক্ষিত হয়, যেমনÑ যান চলাচল বিঘ্নিত হওয়া, শিক্ষাব্যবস্থা ব্যাহত হওয়া, ব্যবসায়িক কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়া এবং জনসাধারণের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বেড়ে যাওয়া। আন্দোলনের কারণে একদিকে যেমন সমাজের কিছু অংশের দাবি পূরণের আশায় আশা তৈরি হয়, তেমনি অন্যদিকে সাধারণ মানুষের জীবনে অব্যক্ত কষ্ট এবং অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এজন্য আন্দোলনের সময় নির্দিষ্ট সীমা ও সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন যাতে জনজীবনে অতিরিক্ত দুর্ভোগ না হয়।


আন্দোলনের কারণে সাধারণ মানুষের চরম দুর্ভোগ

গোলাম মাওলা হাবিব

শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিক বিভাগ

মানুষ মাত্রই চাহিদাসম্পন্ন প্রাণী, তার যতই ধন-সম্পদ থাকুক না কেন তার আরও চাই। আর মানুষের পাওয়াটা হতে পারে কোনো ব্যক্তির কাছে বা সমাজের কাছে অথবা রাষ্ট্রের কাছে। যখন মানুষ তার চাওয়াকে পাওয়া রূপে রূপান্তর করতে চায় তখন বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। যেমনÑ যানবাহনে চলাচলে বিঘ্ন, রাস্তা অবরোধ, হরতাল ইত্যাদির কারণে সাধারণ মানুষ যাতায়াতে অসুবিধায় পড়ে। ছাত্ররা যথাসময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছাতে পারে না। দেশের বিভিন্ন পদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা তাদের কর্মস্থলে যথাসময়ে যেতে পারে না ফলে রাষ্ট্র-সেবা বিঘ্ন ঘটে। প্রথমত অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন, এ আন্দোলনের কারণে দেশের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক গতি স্থির হয়ে যায়। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রবাদির মূল্য বৃদ্ধি পায়, যার ফলে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এটা অসহনীয় হয়ে দাঁড়ায়। তার পাশাপাশি যারা দৈনিক জীবিকার উপর নির্ভরশীল, তারা আয়ের উৎস হারায়। দ্বিতীয়, ত্বরিত সেবা ব্যাহত, ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স এবং জরুরি আমদানি-রপ্তানি পণ্য পৌঁছাতে বিঘ্ন। তৃতীয়, স্বাস্থ্যঝুঁকি আন্দোলনে অনেক সময় ধ্বংস বা সংঘর্ষ সৃষ্টি হওয়ার কারণে আন্দোলনকারীর বা সাধারণ মানুষের আহত হওয়ার ঝুঁকি থাকে, এর পাশাপাশি দূর-দূরান্ত থেকে আহত রোগীদের জরুরি সেবা গ্রহণে বাধাগ্রস্ত হয়। যার ফলে রোগীর মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। চতুর্থ, মানসিক চাপ সৃষ্টি। আন্দোলনের কারণে সৃষ্ট হওয়া সহিংসতা ও সংঘর্ষের ভয় মানুষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। পঞ্চম, আন্দোলনের কারণে অনেক সময় দেখা যায় আন্দোলনকারীরা দেশের সম্পদ জ্বালাও-পোড়াও এবং লুটপাটের মাধ্যমে নষ্ট করে ফেলে। সুতরাং আন্দোলন যেমন সামাজিক ন্যায়বিচার অথবা অধিকার আদায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, ঠিক তেমনি এই আন্দোলনের জন্য যেন সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন স্বাপরিক জীবনে কোনো দুর্ভোগ বা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি না হয়, সেটি আন্দোলনকারীদের মাথায় রাখা উচিত এবং সচেতন থাকা উচিত।


সুশৃঙ্খল ও জনমুখী আন্দোলনই পারে গণসমর্থন আদায় করতে

মারিয়া হাবিব

শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ

আন্দোলন গণতান্ত্রিক অধিকার। সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন গুষ্ঠিগুলোর আন্দোলন প্রায় নিয়মিত হয়ে উঠেছে। তবে এর ফলাফল প্রায়ই সাধারণ মানুষের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। রাস্তায় অবরোধ, পরিবহন বন্ধ বা হঠাৎ সংঘর্ষের কারণে জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে। অফিসগামী মানুষ সময়মতো কর্মস্থলে পৌঁছাতে পারেন না, শিক্ষার্থীদের ক্লাস বা পরীক্ষা বিঘ্নিত হয়, এমনকি রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সও আটকা পড়ে যায়। যেমন তিতুমীর কলেজের আন্দোলনে শিশুসহ কয়েকজন আহত হয়েছেন, তা এই সমস্যার গভীরতা স্পষ্ট করে। এক্ষেত্রে আন্দোলনকারীদের যেমন দায়িত্বশীল হওয়া উচিত, তেমনি প্রশাসনকেও সচেতন পদক্ষেপ নিতে হবে। সমস্যার সমাধানে আলোচনা এবং সমঝোতার মাধ্যমে উত্তরণের পথ খোঁজা জরুরি। অন্যথায়, জনদুর্ভোগের এই চক্র অব্যাহত থাকবে। আন্দোলন যতই ন্যায্য হোক না কেন, তা যদি জনজীবনে দুর্ভোগ ডেকে আনে, তবে আন্দোলনের নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। একটি সুশৃঙ্খল ও জনমুখী আন্দোলনই পারে গণসমর্থন আদায় করতে এবং প্রকৃত পরিবর্তন আনতে।