আইনশৃৃঙ্খলায় সরকারের সর্বোচ্চ মনোযোগ দরকার

মুহম্মদ আকবর ও সৈয়দ রিফাত
২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
আইনশৃৃঙ্খলায় সরকারের সর্বোচ্চ মনোযোগ দরকার


প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। রাজধানীতে রেল ও সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ; বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংঘর্ষ, হামলা ও ভাঙচুর, নানা দাবিতে সভা-সমাবেশকে কেন্দ্র করে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া এবং দুটি পত্রিকা অফিসের সামনে অভূতপূর্ব কর্মসূচি ও আতঙ্ক তৈরির ফলে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বিরাজ করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নিয়মিতভাবেই নানা ধরনের অস্থিরতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আরও তৎপর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। মানুষ স্বাভাবিক অবস্থার ধারেকাছেও নেই উল্লেখ করে তারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারকে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের শান্ত রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোকেও বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো বিভ্রান্তি দেখা দিলে বিদেশিদের কাছে তা স্পষ্ট করতে সরকারকে আরও তৎপর হতে হবে।

গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামে আদালত এলাকায় সম্মিলিত সনাতনী

জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর অনুসারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আইনজীবীদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষে এক আইনজীবী খুন হন। এর রেশ এখনও অব্যাহত আছে। এ ব্যাপারে কোনো কোনো মহল থেকে উসকানিমূলক বক্তব্য এলেও বিএনপি, জামায়াত, সিপিপি, গণতন্ত্র মঞ্চসহ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা দেশবাসীকে ধৈর্য ধারণ এবং শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে আমাদের সময় কথা বলেছে দেশের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে। তারা যার যার জায়গা থেকে দায়িত্বশীল আচরণের জন্য সব পক্ষের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।

লেখক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, এতদিন দেশে একটি অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ছিল। তার পতন হওয়ার পর একটি শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। এই শূন্যতা পূরণ করতে হবে। একটি নির্বাচিত সরকারই পারে সেই শূন্যতা পূরণ করতে। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তৎপর হতে হবে।

৫ আগস্টের পর থেকে চলমান সহিংসতা এবং সর্বশেষ মঙ্গলবারে চট্টগ্রামে আদালত চত্বরে আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এটি একটি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। সরকারকে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনতে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করতে হবে। পুলিশ আগের মতো কাজ করছে না। তাদের ভেতরও বেশ উৎসাহের অভাব দেখা যাচ্ছে। এটি ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, সরকারের গোয়েন্দা বিভাগগুলো এখনও তৎপর নয়। সরকার থেকে বলা হচ্ছে এসব ঘটনায় যারা সামনে আছে শুধু তারাই নয়, পেছনেও লোক আছে। সে ক্ষেত্রে ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত করে সেই পেছনের ঘটনাগুলোও জানতে হবে। আবার গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে তৎপর করতে না পারলে, আগে থেকে ঘটনাও জানা যাবে না।

ছাত্রদের সংঘর্ষে জড়ানো দুঃখজনক উল্লেখ করে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, যে ছাত্ররা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলন সফল করল তারাই আবার নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। এর মূল কারণ বিশ^বিদ্যালয়, কলেজগুলোতে ছাত্র সংসদ চালু না হওয়া। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে হবে। আর সম্মিলিতভাবে প্রাথমিক দায়িত্ব হবে যার যার অবস্থান থেকে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা।

বিশিষ্ট রাষ্ট্রচিন্তক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের দুই দিক থেকে চিন্তা করতে হবে। বর্তমানে একটা অচলাবস্থা বিরাজ করছে এবং মানুষের নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। এই সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান করতে হবে। আবার এটাও তো সত্য যে, দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসন ফেল করছে। শিক্ষক দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। ছাত্রছাত্রীরা কোন প্রক্রিকায় চলবে, এ নিয়ে তারা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছে। পুলিশ প্রশাসনও নৈতিক শক্তি হারিয়ে ফেলেছে, মনোবল কম।

করণীয় সম্পর্কে আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, তারপরও পুলিশ-র‌্যাবকে কাজে লাগিয়ে খুনাখুনি-মারামারি যাতে নয় হয়, সর্বত্র আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়Ñ এই বিষয়টাকে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে, বন্ধ করার উপায় বের করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রফেসর ইউনূস সাহেব যে জায়গায় আছেন, সেখান থেকে সব দেখতে পারছেন না। অন্য উপদেষ্টারা দেখতে পারছেন। ফলে উপদেষ্টা পরিষদে বিস্তর আলোচনা করে সমস্যার সমাধান বের করতে হবে। আন্দোলনকারীরা কী চাইছে, তাদের দাবি নিয়ে ভাবতে হবে, যা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে। আবার অন্তর্বর্তী সরকার সব সমাধান করতে পারবে নাÑ সেই কথাটাও ভাবনায় রাখতে হবে।

আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, অবস্থা ভালো না। আগে থেকেই খারাপ ছিল, এখন তা ফেটে বের হচ্ছে। গ্রামে, শহরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সরকারি অফিসে এই অবস্থা বিরাজ করছে। যে রকম অবস্থা হলে মানুষ সন্তুষ্ট থাকে এই অবস্থার ধারে-কাছে তারা নেই। সুতরাং চলমান পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য দেরি করা চলবে না। পাশাপাশি জনসাধারণও উচিত নিজ নিজ এলাকায় সচেতন থেকে আইনশৃঙ্খলার প্রতি সম্মানের দৃষ্টি দিয়ে কাজ করা। জনসচেতনতা থাকলে এসব সমস্যা সহজেই সমাধান করা যায়।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি প্রতিবেশী দেশ ভারতকেও ধৈর্যের সঙ্গে দেখা উচিত বলে মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে প্রকৃত ঘটনা স্পষ্ট করলে এরপর তো ভারতের বিভ্রান্তি থাকার কারণ দেখি না। ভারতেও অনেক ঘটনা ঘটে, যেগুলো নিয়ে আমরা কোনো কথা বলি না। তাদেরও এই বিষয়গুলো ধৈর্যের সঙ্গে দেখা, বোঝা এবং যুক্তিসঙ্গত অবস্থানে থাকাই উত্তম বলে আমি মনে করি। স্পর্শকাতর সময়ে আবেগী প্রতিক্রিয়া দেখানো ঠিক হচ্ছে না।

সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, বিভ্রান্তি দূর করতে সরকারকে প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উপস্থাপন করতে হবে। বিশেষ করে সম্প্রতি গ্রেপ্তারকৃত সনাতনী জাগরণ মঞ্চের নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগের ধরন, অভিযোগের ভিত্তিতে সরকারের স্বাভাবিক যে উদ্যোগ তা উপস্থাপন করলেই আমার মনে হয় বিভ্রান্তি দূর করা সম্ভব। এ ছাড়া চট্টগ্রামের ঘটনায় তো সরকার দায়ী নয়। সুতরাং যারা উত্তেজনা ছড়িয়ে ঘটনাটি ঘটাল, এসব তথ্য স্পষ্ট করাই উত্তম সমাধান।

সনাতনী জাগরণ মঞ্চের নেতাকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় দিল্লি ও ঢাকার পাল্টাপাল্টি বিবৃতি বিষয়ে এম হুমায়ুন কবির বলেন, এটাতো ঢাকাকে করতেই হবে। সরকার তার স্বাভাবিক কূটনৈতিক কাজটিই করেছে। যেটা এতদিন ছিল না। আমরা অনেক কিছুই হজম করে নিয়েছি।

সাম্প্রতিক ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্কে ফাটল ধরছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা ভারত থেকে বিদ্যুৎ, ডিজেল, পেঁয়াজ, আলু আমদানি করছি। টাকাও পরিশোধ করছি। অর্থাৎ তাদের সঙ্গে আমাদের ব্যবসায়িক স্বাস্বাভাবিক সম্পর্ক তো আছেই। তবে ভিসার ক্ষেত্রে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক শিথিলতা দেখা গেছে।