দ্বিকক্ষ সংসদ, উপ-প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রস্তাব
৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রসংস্কারে উদ্যোগ নিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশনসহ ১০টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। এরই মধ্যে সংবিধান বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলগুলো মতামত দিয়েছেন। পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালু, দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়া, উপ-প্রধানমন্ত্রী, উপ-রাষ্ট্রপতি, সংসদে উচ্চকক্ষ, গণভোটের বিধান, আনুপাতিক হারে ভোটের বিধান, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য স্থাপনসহ সংবিধানে বেশ কিছু পরিবর্তনের পরামর্শ এসেছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা পরামর্শগুলো আমরা লিপিবদ্ধ করছি। যেসব বিষয়ে এখনও ঐকমত্য আছে সেগুলোও নোটডাউন করছি। আমরা চেষ্টা করব, যাতে আমাদের প্রস্তাবনায় সামঞ্জস্য থাকে, পরস্পরবিরোধী না হয়।
তিনি বলেন, আমরা স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছি। আরও কয়েকটি সংগঠন ও নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলব। আপাতত সাতটি লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি। এখানে কী হবে, সেটা আমরা চূড়ান্ত করতে পারব। কিন্তু কোনো প্রক্রিয়ায় হবে, সেটি আমরা এখনই বলতে পারব না।
এদিকে লিখিতভাবে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব পাঠাতে রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুরোধ করে সংস্কার কমিশন। এ প্রেক্ষিতে গতকাল সংসদ ভবনে সংস্কার কমিশনের প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রস্তাবনা জমা দেয় বিএনপি। পরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে শুরু করে তফসিল পর্যন্ত ৬২টি জায়গায় বিভিন্ন সংশোধনীর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবনার মূল অংশে কিছু নতুন প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। জনগণের আকাক্সক্ষা এবং জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে শহীদের রক্তের অঙ্গীকার, বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনা করে ভবিষ্যতে যাতে সংসদীয় একনায়কতন্ত্র সৃষ্টি না হয়, সেগুলো মাথায় রেখে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, একই ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন নাÑ এমন বিধান, সংসদে উচ্চকক্ষ সৃষ্টি, অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিমকোর্টের অধীনে রাখা, গণভোটের বিধান পুনঃপ্রবর্তনের প্রস্তাব করেছে বিএনপি।
তিনি বলেন, প্রস্তাবনায় প্রজাতন্ত্র, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, তফসিলসহ সব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে সংবিধানে গণতান্ত্রিকব্যবস্থা সাধিত হয়। রাষ্ট্রের সব অঙ্গে যাতে সব ক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি হয়, সেই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
সংবিধান পুনর্লিখনের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, এ বিষয়ে বিএনপি কোনো বক্তব্য দিয়েছে কিনাÑ এ প্রশ্নে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাপক ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব করেছে তারা, যাতে এটা গণতান্ত্রিক হয়। জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণ হয়।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
সংসদ না থাকায় সংবিধান সংশোধন কীভাবে হবেÑ এ প্রশ্নে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাবগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে পেশ করবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে সব রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, বিশেষজ্ঞসহ সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তারা চূড়ান্ত করবেন। দেখা যাবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সবাই একমত হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দ্বিমত থাকতেই পারে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য থাকবে, সেগুলো তারা যদি অঙ্গীকার করেন, নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিফলন ঘটান, তাহলে সবার অঙ্গীকার থাকবে পরবর্তী নির্বাচনে যারাই ক্ষমতায় আসুক, তারা সংবিধান সেভাবে পরিবর্তন করবে।
তিনি আরও বলেন, তাদের প্রস্তাবনায় ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলা হয়েছে। সংস্কার কমিটি সুপারিশ চূড়ান্ত করে সরকারকে দেবে। তারপর নির্বাচিত সরকার এসে এসব সংশোধন করবে।
বিএনপির প্রস্তাব প্রসঙ্গে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এখন পর্যন্ত তাদের প্রস্তাবগুলো আমরা পড়িনি। যতক্ষণ না পড়ছি, ততক্ষণ মন্তব্য করা সম্ভব নয়। অন্যান্য দলের পক্ষ থেকেও প্রস্তাব পেয়েছি। সেগুলোও পড়ব। বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের কাছে যে প্রস্তাব পাচ্ছি, সেগুলো থেকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সুপারিশ তৈরি করা আমাদের দায়িত্ব।
গত ২৫ নভেম্বর সংবিধান সংস্কার কমিশনের নিকট গণ-অধিকার পরিষদের সাত দফা প্রস্তাবনা তুলে দেয় সদস্য সচিব ফারুক হাসানের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল। গণ-অধিকার পরিষদ মনে করে, বর্তমান সংবিধান সংস্কার কমিশনের আইনি সুযোগ নেই সংবিধান পুনর্লিখন বা সংশোধন করার। তবে এই কমিশন কিছু সুপারিশ করতে পারে। তাদের সংস্কারমূলক সুপারিশের মধ্যে রয়েছেÑ একই ব্যক্তি একই সময়ে দলীয় প্রধান এবং সরকারপ্রধান যেন থাকতে না পারে, সে ব্যবস্থা রাখার সুপারিশ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য স্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমিয়ে, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই একই ব্যক্তিকে দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকার সুযোগ রাখা যাবে না। কোনো অবস্থাতেই একই ব্যক্তিকে দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট থাকার সুযোগ রাখা যাবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে হবে। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদের আসন বিন্যাস করতে হবে। সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য স্থাপনের স্বার্থে আগামী দুই মেয়াদের জন্য মিশ্র পদ্ধতিতে আসন বণ্টন হতে পারে। সেক্ষেত্রে ৩০০ আসনে নির্বাচনের পাশাপাশি ১০০ আসন সংখ্যানুপাতে বণ্টিত হতে পারে।
একই দিন জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে সেটি গণমাধ্যমে আসেনি। যদিও গত ৯ অক্টোবর সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবের বিষয়ে দলটি জানিয়েছিল, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রাখার বিধান সংযুক্ত করতে হবে। একই ব্যক্তি পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না।
জানা গেছে, সংবিধান সংস্কার নিয়ে কমিশনের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ৪৭ হাজার ৯৭ জন মতামত দিয়েছেন। এ ছাড়া ২৮ সংগঠন, সুশীল সমাজের ২৩ জন প্রতিনিধি, পাঁচজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং ১০ জন তরুণ চিন্তাবিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে কমিশন। ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা কমিশনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। গতকাল বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধানের বিষয়ে বিবিএসের মাধ্যমে আগামী সপ্তাহ থেকে সারাদেশে জরিপ শুরু হবে, যেন সব ধরনের মানুষের মত আমরা পাই। নগর, গ্রাম, বয়স্ক, তরুণদের। এটাই আমাদের কাজ। কাজের অগ্রগতি হচ্ছে। আমরা আশাবাদী। রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আশা করছি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সুপারিশগুলো দিতে পারব। ৬ অক্টোবর কমিশন যাত্রা শুরু করেছিল। আমরা আশা করি, ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় পাব। যদিও বলা হচ্ছে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। আমরা আমাদের প্রস্তাব দেব। নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে নির্বাচন সংস্কার সংক্রান্ত কমিশন বলবে। নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেবে অন্তর্বর্তী সরকার।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ আরও বলেন, সংবিধান শুধু একটি নির্বাচনের বিষয় নয়। সংবিধানে নির্বাচনের বিষয়ে যেসব মতামত এসেছে সেগুলোর ভিত্তিতে সুপারিশ তৈরি করব। সুনির্দিষ্ট করে নির্বাচন কবে হবে, কী প্রক্রিয়ায় হবে, সেটা সরকার বলতে পারে।
দেশে বর্তমানে সংসদ কার্যকর নেই। যে কারণে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবগুলো কীভাবে অনুমোদন করা যায়, সেটি নিয়েও নানা মতামত আসছে। এ ক্ষেত্রে কারও কারও পরামর্শ গণপরিষদ গঠন করে সংবিধানের অনুমোদন করা। আবার অনেকে বলছেন, সংস্কার প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত করে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে দিলে তারা তা সংসদে অনুমোদন করবে।
গত ৬ অক্টোবর গঠন করা হয় সংবিধান সংস্কার কমিশন। কমিশন গঠনের দিন থেকে ৯০ দিনের মধ্যে সরকারপ্রধানের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে কমিশনকে। প্রস্তবনা চূড়ান্ত করে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারের কাছে প্রদান করা হবে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন