এমডির অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে
আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক তদন্তে তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের পাশাপাশি ব্যাংক ও আমানতকারীদের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকার প্রমাণ পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকটির এমডি হিসেবে তার পুনর্নিয়োগের আবেদন নাকচ করা হয়। পাশাপাশি দ্রুত ব্যাংকটিতে একজন নতুন এমডি নিয়োগেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়। গত সপ্তাহে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান বরাবর এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিষয়টি নিশ্চিত করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুশনে আরা শিখা।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে এখনও অফিস করছেন শফিক। সেই সঙ্গে তার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য পুনরায় আবেদন করেছেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান।
এ বিষয়ে শফিক আমাদের সময়কে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য ব্যাংক থেকে পুনরায় আবেদন করা হয়েছে। আপাতত নতুন সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত ব্যাংকটি থেকে আমাকে এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শফিকের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত মাসে ব্যাংকটিতে এমডি হিসেবে তার পুনর্নিয়োগ আটকে দিয়ে বিশদ তদন্তের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন ব্যাংকটিতে একজন ভারপ্রাপ্ত এমডি নিয়োগের জন্য ব্যাংকের চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দেওয়া হয়। তবে শফিক তথাকথিত পরিচালনা পর্ষদকে ম্যানেজ করে সে সময় ব্যাংকটিতে ভারপ্রাপ্ত এমডি নিয়োগ করা থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হন। শুধু তাই নয়, অভিযোগ থেকে পরিত্রাণে তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে তদবির করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশদ পরিদর্শনে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ায় তার পুনর্নিয়োগের আবেদন চূড়ান্তভাবে নাকচ করে গত ১৯ নভেম্বর ব্যাংকটির চেয়ারম্যানকে চিঠি পাঠানো হয়।
চিঠিতে বলা হয়, ব্যাংক ও আমানতকারীদের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগ বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় শফিককে এমডি পদে পুনর্নিয়োগের অনুমোদন দেওয়া যায়নি। সেই সঙ্গে তার অর্থ আত্মসাৎ, পাচার ও ব্যাংক অব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিষয়ে এবং আত্মসাতকৃত অর্থ আদায়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগকে অবহিত করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ ছাড়া নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে ব্যাংকের এমডির শূন্যপদ পূরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে চেয়ারম্যানকে পরামর্শ দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ব্যাংক কোম্পানি আইন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের এমডি পদ শূন্য হওয়ার তিন মাসের মধ্যে তা পূরণ করতে হবে। সেই সঙ্গে নতুন এমডি নিয়োগ না দেওয়া পর্যন্ত ব্যাংকের সিনিয়রদের মধ্যে থেকে একজনকে ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে দায়িত্ব দিতে হবে। জানা যায়, গত ৩০ সেপ্টেম্বর আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকের মেয়াদ শেষ হয়। তার আগে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিয়ে গত ৯ সেপ্টেম্বর তাকে পুনর্নিয়োগ দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করা হয়।
এর পরপরই তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ব্যাংকের কর্মকর্তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগ পাঠায়। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে তার পুনর্নিয়োগ আটকে দিয়ে বিশদ তদন্ত শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে গত ২৩ অক্টোবর দৈনিক আমাদের সময়ে ‘অনিয়মে জড়িত আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের এমডি : পুনর্নিয়োগ আটকে দিল বাংলাদেশ ব্যাংক’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
ওই প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাঠানো অভিযোগের বরাত দিয়ে বলা হয়, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের এমডি পদে ২০১৪ সালে শফিক নিয়োগ পান। শুরুতেই তিনি অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করেন ব্যাংকটির ভাইস প্রেসিডেন্ট পারভেজ ইউসুফ। যদিও ২০১৫ সালে তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করে সতর্ক করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি থামেনি। এই কয়েক বছরে শফিককে পুনর্নিয়োগ দিতে না চাইলেও তিনি বিভিন্ন গোষ্ঠীর মাধ্যমে প্রভাব খাটিয়ে অনাপত্তি বের করে নেন। গত ১০ বছরে শফিক ও পারভেজ ইউসুফ নিয়োগ বাণিজ্য থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় জামানত ছাড়া ঋণ ও ঘুষের বিনিময়ে ঋণ দেওয়া এবং ঋণখেলাপিদের সঙ্গে অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে টাকা ফেরত না দেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেন।
নিয়ম লঙ্ঘন করে অফিস করছেন এমডি : গত ১৯ নভেম্বর আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের এমডি হিসেবে শফিকের পুনর্নিয়োগের অনুমোদন নাকচ করা হয় এবং এ সংক্রান্ত চিঠি ওইদিনই দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ব্যাংকটিতে পৌঁছানো হয়। ফলে ওইদিন থেকেই তিনি আর ব্যাংকের এমডি নন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই নির্দেশনা লঙ্ঘন করে তিনি এখনো নিয়মিত অফিস করার পাশাপাশি ব্যাংকের সব দাপ্তরিক কাজ দেখছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার আমাদের সময়কে বলেন, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের এমডি হিসেবে শফিকের পুনর্নিয়োগ নাকচ করা হয়েছে। বিষয়টি ব্যাংকটিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে এমডি হিসেবে তার আর অফিস করার সুযোগ নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে অফিস করার বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেব। তার আগে ব্যাংকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিগগির বৈঠক হবে।
এদিকে এমডির অফিস করার সতত্য যাচাইয়ে গতকাল বিকালে সরেজমিনে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে যান এই প্রতিবেদক। এমডির অফিস ফ্লোরের অভ্যর্থনা কেন্দ্রে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চাওয়া হলে তিনি অফিসে নেই বলে জানান সংশ্লিষ্ট ডেস্কের দায়িত্বরত একজন নারী কর্মী। এ সময় তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এমডির পিয়ন কালাম জানান, এমডি স্যার সকালে অফিসে এসেছিলেন। তবে হঠাৎ একটি কাজে ১১টার দিকে বের হয়েছেন। এমডি স্যার অফিস করেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে কালাম বলেন, স্যার রেগুলার অফিস করেন। নিয়মিত অফিস করার বিষয়টি এমডি নিজেও স্বীকার করেছেন।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন