অনুমতি-নিষিদ্ধের দোলাচলে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা

তাওহীদুল ইসলাম
২২ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
অনুমতি-নিষিদ্ধের দোলাচলে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে ২০ ধরনের যানবাহনের নিবন্ধন দেয়। এর মধ্যে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নেই। কিন্তু নিবন্ধনের সুযোগ না থাকলেও ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার আমদানি ও উৎপাদন চলছে অবাধে। যানজট ও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী হিসেবে চিহ্নিত এসব যানবাহন চলাচলের বৈধতা দিতে চলছে আন্দোলন। যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে জীবিকা নির্বাহ ও কমর্সংস্থানকে।

ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ-আন্দোলনে গতকাল ভোগান্তিতে পড়েন রাজধানীবাসী। এরও দুদিন আগে ঢাকা মহানগর এলাকার সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল তিন দিনের মধ্যে বন্ধ করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এর প্রতিবাদে আন্দোলন করছেন এর চালকরা।

জানা গেছে, দেশের কিছু সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন এলাকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কিছু কিছু তিন চাকার যানের নিবন্ধন দিয়েছেন। ২০১০ সাল থেকে এর শুরু। গত ১৫ মে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের এক সভায় তৎকালীন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঢাকায় ব্যাটারি বা যন্ত্রচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশনা দেন। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রাজধানীর আগারগাঁও ও মিরপুর-১০ নম্বরে সড়ক অবরোধসহ ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন এসব যানের চালকরা। এরপর ২০ মে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘নিম্ন ও স্বল্প’ আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেন। গতকালও একই পরিস্থিতি দেখেন নগরবাসী। তাই অটোরিকশা চালকরা মনে করতে শুরু করেছেন, আন্দোলন বা ভাঙচুর করলেই অনুমতি মিলতে পারে। বিক্ষোভকারী চালকদের দাবি, কোনো শর্ত ছাড়া অটোরিকশা ও ইজিবাইক চালাতে দিতে হবে। তা না হলে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।

জানা যায়, ব্যাটারি বা মোটরচালিত রিকশা বা ভ্যান বা অনুরূপ শ্রেণির থ্রি-হুইলারের কারণে ঢাকা নগরীতে সড়ক নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। গত অক্টোবর পর্যন্ত নিবন্ধিত যানবাহন হচ্ছে ৬২ লাখ। এর মধ্যে গণপরিবহনের মূল বাহন বাস-মিনিবাস আছে মাত্র ৮৪ হাজার। যা মোট নিবন্ধিত যানের ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। তিন চাকার যানবাহনের মধ্যে শুধু অটোরিকশা ও অটোটেম্পোর নিবন্ধন দেয় বিআরটিএ। এ দুটি যানের বৈধ সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৪২ হাজার। চাহিদার তুলনায় গণপরিবহনের এই স্বল্পতার সুযোগে কারিগরিভাবে ত্রুটিপূর্ণ তিন চাকার ব্যাটারি ও ইঞ্জিনচালিত রিকশায় ঢাকাসহ সারাদেশ ছেয়ে গেছে। ত্রুটিপূর্ণ এই যানবাহনগুলো দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নানা ত্রুটিযুক্ত বিপুল পরিমাণ এসব যানের চলাচল নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ। তবে এই যানবাহনগুলোর সঙ্গে যে পরিমাণ মানুষ যুক্ত রয়েছে এবং যেভাবে ছড়িয়েছে, তা হুট করে বন্ধ করা যাবে না।

বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী আমাদের সময়কে বলেন, ব্যাটারচালিত রিকশা কোনো যান্ত্রিক বাহন নয়। এটির কখনো বৈধতা দেয় না বিআরটিএ। সড়ক দুর্ঘটনায় এ বাহন অনেকাংশে দায়ী।

সংশ্লিষ্টরা জানান, হাইকোর্ট শ্যালো মেশিনের ইঞ্জিনে নির্মিত নছিমন, করিমন, আলমসাধু বন্ধে ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি আদেশ দিয়েছেন। ২০১৫ সালের ১ আগস্ট থেকে ২২টি জাতীয় মহাসড়কে অটোরিকশাসহ এসব যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে রিকশা চলাচলই নিষিদ্ধ। দুই সিটি করপোরেশন প্যাডেলচালিত প্রায় দুই লাখ ৩৩ হাজার রিকশা ও ভ্যানের অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু কয়েক বছরে এসব রিকশায় ব্যাটারি বসানো হয়েছে। বছর দুয়েক ধরে বড় আকারের ‘হাইব্রিড’ ব্যাটারি রিকশা সড়কে চলছে। অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর সড়কে পুলিশ না থাকায়, মূল রাস্তাতেও দাপটে চলতে শুরু করে ইজিবাইক, ব্যাটারি রিকশা ।

২০১৯ সালের জুনে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক করে ‘দুর্ঘটনা হ্রাসকল্পে ছোট গাড়ি নিয়ন্ত্রণে সুপারিশ প্রণয়ন কমিটি’ করে বিআরটিএ । ২০২১ সালের গত জানুয়ারিতে ১২ সদস্যের এই কমিটির প্রতিবেদনে জানায়, সারাদেশে অটোরিকশাসহ কমপক্ষে ১৫ লাখ ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যানবাহন চলছে। এতে অন্তত ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান ও জীবিকা হয়েছে। তাই সড়ক নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হলেও আর্থসামাজিক নিরাপত্তা বিবেচনায় এসব যানবাহনকে অনুমতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন। স্থানীয়ভাবে নির্ভরশীলতার কারণে বারবার চেষ্টা করেও এসব গাড়ি বন্ধ করা যায়নি। অবৈধ এসব গাড়িকে চলার সুযোগ করে দিয়ে বছরে হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে। বৈধতা দিলে চাঁদাবাজি বন্ধ হবে, সরকার রাজস্ব পাবে।