রাজনীতিতে এসে আলাদিনের চেরাগ পান কিরণ

ফয়সাল আহমেদ, গাজীপুর
২০ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
রাজনীতিতে এসে আলাদিনের চেরাগ পান কিরণ


১৯৮৫ সালের দিকে এলিট প্রিন্টিং প্রেস নামের একটি কারখানায় বাইন্ডারম্যান পদে চাকরি করতেন আসাদুর রহমান কিরণ। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় এক সময় যোগ দেন রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির মাধ্যমে। ওই সময় তিনি জাতীয় পার্টির অঙ্গসংগঠন জাতীয় যুব সংহতির টঙ্গীর ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এরশাদ সরকারের সময় ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে পরিচিতি পান ভূমিদস্যু হিসেবে। এরপর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আসন পাকাপোক্ত করে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এবং দুই দফায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়রের পদ বাগিয়ে নেন তিনি। এই সুযোগে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে সেই বাইন্ডারম্যান কিরণ

এখন শত শত কোটি টাকার মালিক।

অভিযোগ রয়েছে, অপরাধ ও মাদক ব্যবসায় পৃষ্ঠপোষকতা, চাঁদাবাজি ও কমিশন বাণিজ্য, দরপত্র ও ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, সংখ্যালঘুদের জমি দখল এবং শিল্প ও হোল্ডিং ট্যাক্স কম দেখানোসহ বিভিন্ন খাত থেকে সিটি করপোরেশনের তহবিল আত্মসাৎসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন আসাদুর রহমান কিরণ। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সাড়ে তিন মাস পর অবশেষে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় গতকাল মঙ্গলবার সীমান্তে বিজিবির হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন কিরণ।

মূলত গাজীপুরে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল ও আওয়ামী লীগ আজমত উল্লাহর ইশারায় চলতেন কিরণ। এ সুযোগে কিরণ সিটি করপোরেশনকে পরিণত করেছিলেন লুটপাটের কেন্দ্রে। আলাদিনের চেরাগের মতো সম্পদও গড়েছেন দেশ ও বিদেশে। তার অবৈধ অর্থের একটি ভাগ দিতেন আজমত ও রাসেলকেও।

স্থানীয় লোকজন জানান, টঙ্গীর পাগাড় মৌজায় সনাতন ধর্মের লোকের দখলে থাকা বহু জমি দখলে নিয়ে প্লট বানিয়ে চড়া দামে বিক্রি করেন। একই সময় টঙ্গীর বিসিক এলাকায় শ্রমিকনেতা হিসেবেও আধিপত্য বিস্তার করেন তিনি। সে সময় কেউ জমি দিতে না চাইলে রাজনৈতিক চাপ ও সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে উচ্ছেদ করতেন। পাগাড় শিল্পাঞ্চল এলাকা হওয়ায় ওই এলাকায় টার্গেট করে জমি দখল করেন কিরণ। তার ভয়ে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি।

২০০০ সালে টঙ্গী পৌরসভার নির্বাচনের ভোটে ৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কমিশনার নির্বাচিত হন আসাদুর রহমান কিরণ। তত দিনে ক্ষমতা-সম্পদ ও অঢেল অর্থের মালিক হয়ে ওঠেন তিনি। ধীরে ধীরে সাবেক পৌর মেয়র গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহর ‘মাইম্যান’ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেন। এ সুযোগে ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে কিরণের। ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে আজমত উল্লাহ মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী অধ্যাপক আবদুল মান্নানের কাছে পরাজিত হন। পরে ষড়যন্ত্র করে মান্নানকে মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত করিয়ে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পেয়ে যান আজমত উল্লাহর লোক কিরণ।

ভাগ্যের চাকা আরও গতি পায় প্রথম মেয়াদে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই। পরের মেয়াদে জাহাঙ্গীর আলম মেয়র নির্বাচিত হলে ফের তাকেও বরখাস্ত করে কিরণকে বসানো হয় ভারপ্রাপ্ত মেয়রের চেয়ারে। সঙ্গে দেওয়া হয় মহানগর আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ সহসভাপতি পদও। সাধারণ একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর হয়ে প্রতাপের সঙ্গে গাজীপুর সিটি করপোরেশন শাসন করেছেন দুই মেয়াদে।

কিরণের অঢেল সম্পদ : স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টঙ্গীর পাগাড়, ঢাকার আশুলিয়া এবং গাজীপুরে নিজ নামে, স্ত্রী, শ্যালক ও শ্যালিকার নামে শতাধিক বিঘা জমি আছে কিরণের। পাগাড়ে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কিছু জমি রয়েছে, যা নয়ছয় ও ভয়ভীতি দেখিয়ে দলিল করে নিয়েছেন তিনি। উত্তরায় ১১ নম্বর সেক্টরে ৭ নম্বর রোডের ১০ নম্বর বাড়িটি সাততলা। এটি নির্মাণ করতে কমপক্ষে ১৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। একই এলাকার ৭ নম্বর সেক্টরে ১৮ নম্বর রোডে ৯৫ নম্বর বাড়ি রয়েছে। বারোতলা নির্মাণাধীন ওই ভবনের আনুমানিক মূল্য ৩৫ কোটি টাকা। গুলশান ২-এর ৭৯ নম্বর সড়কেও তার একটি ফ্ল্যাট আছে বলে জানা গেছে। ময়মনসিংহের ভালুকায়ও জমি কিনেছেন। টঙ্গীতে কারখানা আছে তার। অভিযোগ আছ, কয়েকশ কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেছেন তিনি। তার স্ত্রী ও সন্তানরা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন বলে জানা গেছে।

হাইকোর্টের আদেশের পরও তদন্ত হয়নি : ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালত গাজীপুরের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে। তবে রহস্যজনক কারণে পরে দুদকের দৃশ্যমান কার্যক্রম চোখে পড়েনি।

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনের অনুষ্ঠান, শোক দিবস ও কর্মকর্তাদের পিকনিকসহ বিভিন্ন দিবসে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন না করেই সিটি করপোরেশনের খরচের তহবিল থেকে কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে কিরণের বরুদ্ধে। এ ছাড়াও বিশ্ব ইজতেমার পরিচালনা ব্যয় দেখিয়ে কোটি কোটি টাকার তহবিল লুট করেছেন তিনি।

সূত্র জানায়, ভারপ্রাপ্ত মেয়রের চেয়ারে বসেই কিরণের নজর পড়ে পূবাইলের চিরুলিয়ায় অর্পিত সম্পত্তির ওপর। ২৩ বিঘা জমি নিজের কব্জায় নেন কিরণ। শিল্পসমৃদ্ধ গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আয়ের সবচেয়ে বড় মাধ্যম শিল্প ও হোল্ডিং ট্যাক্স। আর সেখানেই অনিয়মের বড় ক্ষেত্র তৈরি করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন ভারপ্রাপ্ত মেয়র কিরণ। এ ছাড়া প্রথম দফার বিভিন্ন প্রকল্পের ভুয়া বিল এবং দ্বিতীয় দফায় দায়িত্ব নিয়ে ঠিকাদারদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন নেন কিরণ। শুধু সিটি করপোরেশন নয়, শিল্পাঞ্চল-সমৃদ্ধ গাজীপুর নগরীর অধিকাংশ ব্যবসায়ী-ঠিকাদার ১০ পার্সেন্ট হিসেবেও কিরণকে চেনে-জানে। এ ছাড়াও টঙ্গী ও গাজীপুরের বেশ কিছু কারখানার ঝুট ব্যবসার একক নিয়ন্ত্রণ ছিল তার। টঙ্গীর চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, অপরাধ সাম্র্রাজ্যেও সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

গত ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের মতো কিরণও গা ঢাকা দিয়েছিলন। তবে পার পাননি। গতকাল মঙ্গলবার ভারতে পালানোর সময় যশোরের সীমান্ত এলাকা থেকে কিরণকে গ্রেপ্তার করে বিজিবি।