বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী আজারবাইজান
আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে চলছে ২৯তম কপ সম্মেলন, যেখানে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বমঞ্চে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার সফরের শেষদিন গতকাল বৃহস্পতিবারও তিনি ব্যস্ত সময় পার করেছেন। এদিন তিনি আজারবাইজানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছেন। পরে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের সঙ্গে জলবায়ু সম্মেলনের সাইডলাইনে আলোচনা করেন। ব্রাজিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেরালদো আলকমিনের স্ত্রী লু আলকমিনও ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নিয়ে ড. ইউনূস মন্তব্য করেন, প্রতিবছর কপ জলবায়ু সম্মেলন আয়োজন অপচয় এবং সময়সাপেক্ষ, বরং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার দিকে মনোনিবেশ করা উচিত।
বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের চতুর্থ দিনেও সম্মেলেনর প্রবেশমুখে পরিবেশবাদীরা ন্যায্য অর্থায়নের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন। কপ-২৯ এর সিইও এলনুর সোলতানভ জলবায়ু ক্ষতি মোকাবিলায় বিশ্বের বহুপক্ষীয় উন্নয়ন ব্যাংকগুলোর নির্ধারিত অর্থায়ন লক্ষ্যমাত্রাকে স্বাগত জানালেও আরও অর্থের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, চীন ছাড়া অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আনুমানিক ২.৪ ট্রিলিয়ন ডলার প্রয়োজন, যার ১ ট্রিলিয়ন বাহ্যিক উৎস
থেকে আসবে। তবে তিনি আরও বলেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখতে অর্থায়ন আরও কার্যকর করা প্রয়োজন।
এদিকে গতকাল আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাকুর তেল কোম্পানিতে বাংলাদেশের চাকরির সুযোগ বাড়ানোর আহ্বান জানান। আলিয়েভ বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করতে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় নতুন সম্ভাবনা দেখতে তার সরকারের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল আগামী বছরের প্রথম দিকে ঢাকা সফরের পরিকল্পনা করছে। দেশটি ঢাকায় একটি আবাসিক দূতাবাস খোলার সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছে বলেও জানান তিনি। আলিয়েভ বাংলাদেশের ছাত্র নেতৃত্বাধীন বিপ্লবের প্রশংসা করেন এবং অধ্যাপক ইউনূসকে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য অভিনন্দন জানান।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস দুই দেশের মধ্যে আরও দৃঢ় সম্পর্কের আহ্বান জানিয়ে বলেন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং প্রধান প্রধান আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে সহযোগিতা বৃদ্ধি পেলে উভয় দেশ সমৃদ্ধ হবে। প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ বলেন, আজারবাইজান ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের ডিজিটাইজেশনের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের আগ্রহ প্রকাশ করেন। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক সিনিয়র সচিব লামিয়া মোরশেদ এবং তুরস্ক ও আজারবাইজানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম আমানুল হক উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়া বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের সাইডলাইনে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় তিনি জানান, তার সরকার দেশের তৈরি খাতে আরও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে শ্রম খাতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করবে। শ্রম সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার তুলে ধরে ইউনূস বলেন, তারা সব শ্রম সমস্যার সমাধান করতে চান। থেরেসা মে মানবপাচার ও অভিবাসন বিষয়ে আলোচনা করেন এবং বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ইউনূস আইনগতভাবে ইউরোপে অভিবাসন বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, এটি ঝুঁকি ও অনিয়মিত অভিবাসন কমাবে এবং মানবপাচারের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ হবে। অধ্যাপক ইউনূস থেরেসা মেকে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সময় বাংলাদেশি তরুণদের আঁকা গ্রাফিতি ও ম্যুরাল বিষয়ক বই ‘আর্ট অব ট্রায়াম্ফে’র একটি অনুলিপি উপহার দেন।
কপ-২৯ জলবায়ু সম্মেলনের ফাঁকে গতকাল দুপুরে ব্রাজিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেরালদো আলকমিনের স্ত্রী লু আলকমিন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তারা দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এ সময় ব্রাজিলের সেকেন্ড লেডি অধ্যাপক ইউনূসকে নিয়ে রচিত তার লেখা একটি বই প্রধান উপদেষ্টাকে উপহার দেন এবং সামাজিক ব্যবসার উদ্যোগ শুরু করার কথা জানান। ইউনূস বাংলাদেশ এবং ব্রাজিলের মধ্যে বাণিজ্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
এদিকে কপ-২৯ এর এক সাইড ইভেন্টে বক্তারা বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে জাস্ট ট্রানজিশনে অর্থায়নের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন। ‘অ্যাকসিলারেটিং ফাইন্যান্স ফর জাস্ট ট্রানজিশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান (এনএপি) অনুযায়ী, ২০২৩-২০৫০ সালের মধ্যে পরিবর্তন কার্যক্রম বাস্তবায়নে প্রায় ১১.৬৩ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। এটি ৪.১ মিলিয়ন মানুষের জন্য জলবায়ু সহিষ্ণু কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।
ওশি ফাউন্ডেশন, ইয়ুথনেট গ্লোবাল এবং ফ্রেডরিখ-ইবার্ট স্টিফটুং বাংলাদেশ (এফইএস) নামে একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ওশি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আমিনুর রশিদ চৌধুরী রিপনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফারহিনা আহমেদ। ওশি ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারপারসন এস এম মোর্শেদ এ বিষয়ে তার উপস্থাপনা তুলে ধরেন।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বাকুতে অনুষ্ঠিত কপ-২৯ জলবায়ু সম্মেলনে যোগদান শেষে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দেশে ফিরেছেন। প্রধান উপদেষ্টার উপ প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট প্রধান উপদেষ্টা ও তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে রাত ৮টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছেছেন।
এবারের সম্মেলনে প্রায় ২০০ দেশের দেড়শ রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, প্রায় হাজারখানেক মন্ত্রী ও ৮০ হাজারের মতো সরকারি-বেসরকারি পরিবেশকর্মী অংশগ্রহণ করছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, কানাডা ও ভারতের রাষ্ট্রপ্রধানরা উপস্থিত থাকেননি।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন