ছাত্র-জনতার দখলে জিরো পয়েন্ট, আ.লীগ লাপাত্তা

নূর হোসেন দিবস পালিত

নিজস্ব প্রতিবেদক
১১ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ছাত্র-জনতার দখলে জিরো পয়েন্ট, আ.লীগ লাপাত্তা

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে চলে যান। এরপর থেকে এ পর্যন্ত আর মাঠে নামতে পারেননি দীর্ঘদিন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা এই দলটির নেতাকর্মীরা। এর মধ্যেই আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে গত শুক্রবার দেওয়া এক পোস্টে ঘোষণা করা হয়, শহীদ নূর হোসেন দিবস উপলক্ষে ঢাকার জিরো পয়েন্টের শহীদ নূর হোসেন চত্বরে রবিবার (গতকাল) বিকাল ৩টায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে দলটি। এর পক্ষে টানা প্রচারও চালানো হয় সামাজিক মাধ্যমে। এমনকি গত শনিবার রাতেও ফেসবুকে ছড়ানো হয়- বিভিন্ন জেলা থেকে আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ঢাকামুখী হচ্ছেন। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের এ কর্মসূচি প্রতিহতে পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া হয়। একই দিন দুপুর ১২টায় নূর হোসেন চত্বরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের বিচারের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা।

জনমনে একধরনের ভীতি সঞ্চারিত হয়। কিন্তু কর্মসূচি ঘোষণা ও ব্যাপক প্রচারের পরও শেষ পর্যন্ত নূর হোসেন চত্বর এমনকি বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়েও দেখা মেলেনি আওয়ামী লীগের। গতকাল দিনভর নূর হোসেন চত্বর ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে মুখর। হাজারো ছাত্র-জনতা এতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ছিল বিএনপির নেতাকর্মীদের দখলে। বিএনপি এদিন ‘গণহত্যাকারী পতিত ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দোসরদের সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা এবং বিচারের দাবিতে’ রাজধানীজুড়ে বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে।

গতকাল রবিবার ১০ নভেম্বর ছিল শহীদ নূর হোসেন দিবস। প্রতি বছরের মতো এবারও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। এসব কর্মসূচির মধ্যে ছিল শহীদের মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, শহীদ নূর হোসেন চত্বরে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, আলোচনা সভা ও সেমিনার। এ ছাড়া জুরাইন কবরস্থানে শহীদ নূর হোসেন ও নুরুল হুদা বাবুলের কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, ফাতেহা পাঠ ও মোনাজাত করা হয় গতকাল। নূর হোসেন চত্বরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বিএনপি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, গণসংহতি আন্দোলন, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, গণতন্ত্র মঞ্চ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, বাম গণতান্ত্রিক জোট, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট, ছাত্র ফোরাম, জাতীয় গণফ্রন্ট, নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন ও জাতীয় গণফ্রন্টসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।

নূর হোসেন চত্বরে আওয়ামী লীগ বিক্ষোভ কর্মসূচি ডাকলেও দেখা মেলেনি আওয়ামী লীগ বা দলটির অঙ্গসংগঠনের কোনো নেতাকে। সকাল থেকেই বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ ছাত্র-জনতা সেখানে দলে দলে মিছিলে নিয়ে এসে সমাবেশ করে। গুলিস্তান এলাকায় নামে ছাত্র-জনতার ঢল। অবস্থান নিয়ে তারা দখলে নেয় গুলিস্তানসহ পুরো পল্টন এলাকা। বিবৃতি-বক্তৃতা দেয় ভাগে ভাগে। আওয়ামী লীগের বিক্ষোভ মিছিল প্রতিহত করতে সকাল থেকেই জিরো পয়েন্ট মোড়ে অবস্থান নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউসহ ওই এলাকায় অবস্থান নেয় বিএনপিসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাও। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্যের উপস্থিতি দেখা যায়।

বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাকে সাড়া দিয়ে অবশ্য আওয়ামী লীগের হাতেগোনা কয়েকজন সমর্থক নূর হোসেন চত্বরের কাছাকাছি এলেও তাদের ধরে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।

পল্টন থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাসিরুল আমীন জানান, আওয়ামী লীগ বিক্ষোভ কর্মসূচি আটকদের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষে আইনি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রবিবার জিরো পয়েন্ট মোড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেন, পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের বিচারের দাবিতে আয়োজিত গণজমায়াতে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ থাকলে আওয়ামী লীগ কোথাও মাথা তুলতে পারবে না। আমরা আমাদের বিপ্লবী ভাইদের বলতে চাই, নিজেদের মধ্যে ছোটখাটো বিভাজনগুলো এক পাশে রেখে যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারি তাহলে এ রকম খুনি সংগঠন শুধু এই গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট নয়, বাংলাদেশের কোনো জায়গায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। পুরো বাংলাদেশের বিপ্লবী ছাত্র-জনতার কাছে আমার এই অনুরোধটি থাকল। যতদিন আপনাদের ভোটে একটি গণতান্ত্রিক সরকার না হচ্ছে, ততদিন ওই স্বৈরাচার হাসিনার উৎপাত দেখা গেলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রায় দুই হাজার মানুষকে শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য হত্যা করল। ২ লাখ মানুষকে রক্তাক্ত করল। এর বিচার হওয়া উচিত কি না? এই শেখ হাসিনা প্রত্যেকটি হত্যাকা-ের হুকুমদাতা, তার বিচার হওয়া উচিত কি না?

তিনি আরও বলেন, আমাদের বীর যোদ্ধা যারা এই অভ্যুত্থানে রক্তাক্ত হয়েছেন, হাত-পা হারিয়েছেন, চোখ হারিয়েছেন, এমনকি এখনো স্বৈরাচারের যে কোনো দোসরের অত্যাচারে জীবন দিতে প্রস্তুত সেই সব আহত যোদ্ধাদের প্রতি অনুরোধ করতে চাই আমরা যখন হাসপাতালে তাদের দেখতে গিয়েছি, তাদের রক্তাক্ত স্মৃতিগুলো এখনও রয়েছে। এসব ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পুরো দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে।

গণজমায়েতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, যতদিন গণহত্যার বিচার না হবে, ততদিন আওয়ামী লীগের জনসম্মুখে আসার অধিকার নেই। গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, যতদিন পর্যন্ত তাদের বিচার নিশ্চিত না হয়, ততদিন তাদের জনসম্মুখে আসার কোনো অধিকার নেই। আওয়ামী লীগের বিচার লগি-বৈঠা থেকে শুরু হতে হবে। তাদের নৃশংসতা দেখেছি পিলখানা হত্যাকাণ্ডে, শাপলা চত্বরে আলেম সমাজের ওপর তাদের নৃশংসতা দেখেছি। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে অবশ্যই ফিরবে। তবে সেটি তাদের বিচারের জন্য, ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলার জন্য। গণহত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও এর দোসরদের বাংলাদেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গণজমায়েতে উপস্থিত হয়ে ইসলামি বক্তা রফিকুল ইসলাম মাদানি বলেন, আওয়ামী লীগ ও ভারত ইস্যুতে কোনো ধরনের নমনীয়তা চলবে না। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ এমন কোনো অপরাধ নেই যা করেনি। তাদের ব্যাপারে কোনো আপস করা চলবে না। তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।

বেলা ১১টায় শহীদ নূর হোসেন চত্বরে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান বলেন, আমাদের নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগকে রাজপথে নামতে দেবে না। আওয়ামী লীগের নিরীহ নেতাকর্মীদের উদ্দেশে রাশেদ খান বলেন, আপনারা শেখ হাসিনার ফাঁদে পা দেবেন না।

‘গণহত্যাকারী পতিত ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দোসরদের সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা এবং বিচারের দাবিতে’ গতকাল রাজধানীজুড়ে বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। সকাল থেকেই রাজধানীর সব প্রবেশপথসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে দলটির নেতাকর্মীরা। পাশাপাশি অঙ্গসহযোগী সংগঠনও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, তেজগাঁও, তিতুমীর, বাংলা কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে ও আশপাশের এলাকার দিনভর নানা কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের। এ ছাড়া দলের নির্দেশনা অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকায় দলীয় নেতাকর্মীদের পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ড অপসারণ করেন।

ঢাকার সব প্রবেশপথসহ বায়তুল মোকাররম, হাউজ বিল্ডিং, পল্টন মোড়, মুক্তাঙ্গন, সচিবালয় এলাকা, জিরো পয়েন্ট, গুলিস্তান, দৈনিক বাংলা মোড়, প্রেসক্লাব, বিজয়নগর, রামপুরা, নিউ মার্কেট, শ্যামলী, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরা, বনানী, গুলশান, তেজগাঁও, ফামগেট, পল্লবী এলাকায় বিএনপি নেতাকর্মীরা অবস্থান নেন। ক্ষণে ক্ষণে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ করে আওয়ামী লীগ ও তার দোসরদের বিচারের দাবি জানান তারা।

এ সময় রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা ৩১ দফাসংবলিত লিফলেটও বিতরণ করে বিএনপি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, গতকাল সকাল ৮টা থেকেই জিরো পয়েন্ট মোড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা অবস্থান করছেন। তারা আওয়ামী লীগ বিরোধী বিভিন্ন মিছিল করছেন। পাশাপাশি গণজমায়েতের জন্য তাদের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের সামনে প্রধান সড়কের ওপর অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করতে দেখা গেছে। এ জন্য গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট থেকে স্টেডিয়ামমুখী রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।

গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট ও বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল। জিরো পয়েন্টে একটি জলকামান এবং বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে একটি জলকামান ও রায়ট কার দেখা গেছে। বিজিবিও গাড়ি নিয়ে টহল দিয়েছে এলাকাজুড়ে।