টিআরপি যন্ত্র ক্রয়ে প্রাধান্য পায় ব্যক্তিগত যোগাযোগ

সৈয়দ রিফাত
০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
টিআরপি যন্ত্র ক্রয়ে প্রাধান্য পায় ব্যক্তিগত যোগাযোগ

টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট (টিআরপি) সিস্টেম গড়ে তুলতে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিএল) ‘অডিয়েন্স ইকুইপমেন্ট ডিভাইস’ ক্রয়ে প্রাধান্য দেওয়া হয় ব্যক্তিগত যোগাযোগকে। বিএসসিএলের সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী ড. শাহজাহান মাহমুদ তার ব্যক্তিগত যোগাযোগকে প্রাধান্য দিয়ে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (এআইইউবি) থেকে যন্ত্রাংশ কেনেন। কোনো ধরনের প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডার ছাড়াই ডিভাইস, সফটওয়্যার ও টিআরপি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সেবার জন্য ওই বিশ্ববিদ্যালয়কে কাজ দেয় শাহজাহান মাহমুদের নেতৃত্বাধীন বিএসসিএলের তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ। পর্ষদের ৪৭তম বোর্ড সভায় বুয়েটকে বাদ দিয়ে এআইইউবি কেন কাজ দেওয়া হলো- এ প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। তখন বোর্ড সভায় এ প্রশ্নের উত্তরে শাহজাহান মাহমুদ বলেছিলেন ‘জাস্ট পারসোনাল কানেকশন’। এর মধ্যে টিআরপির ফলাফল নিয়ে অসন্তুষ্টি দেখা দিয়েছে টেলিভিশন চ্যানেল মালিকদের মধ্যে।

জানা যায়, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে বিএসসিএলকে টিআরপি সেবা প্রদানের অনুমতি দেয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। টিআরপি ডিভাইস বা সেটটপ বক্স শুরুতে ২ হাজার এবং পরবর্তী সময়ে ছয় মাসের মধ্যে ক্রমান্বয়ে সেটি ৮ হাজারে উন্নীত করার নির্দেশনা ছিল বিএসসিএলের প্রতি। তবে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় এক বছর পর বিএসসিএলকে কার্যক্রম শুরুর সময় ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। ওই সময়ের মধ্যে কমপক্ষে ৫০০ সেটটপ বক্স স্থাপনের নির্দেশনাও দেওয়া হয়।

তবে এর মধ্যেই ৪৭তম বোর্ড সভায় এআইইউবিকে ২০০টি অডিয়েন্স ইকুইপমেন্ট ডিভাইস ক্রয়ের কার্যাদেশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএসসিএল বোর্ড। ২০২২ সালের ১৬ জুন অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদের ওই সভায় এআইইউবিকে ডিভাইস কেনার কার্যাদেশ প্রদানের কথা জানান বোর্ডের চেয়ারম্যান ও বিএসসিএলের প্রধান নির্বাহী শাহজাহান মাহমুদ। পর্ষদের তৎকালীন পরিচালক ও ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব মাহবুব উল আলম এআইইউবিকে বেছে নেওয়ার ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। জবাবে শাহজাহান মাহমুদ বলেন, ‘জাস্ট পারসোনাল কানেকশন’।

এ ক্ষেত্রে পিপিআর অনুসরণ করা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে শাহজাহান মাহমুদ তখন বলেছিলেন, পরবর্তী সময়ে পিপিআর অনুসরণ করা হবে। অর্থাৎ, শাহজাহান মাহমুদ স্পষ্টতই জানান, তার ব্যক্তিগত যোগাযোগের প্রেক্ষিতে এআইইউবিকে ২০০টি ডিভাইস ক্রয়ের কার্যাদেশ দিতে আগ্রহী তিনি। এ বিষয়ে মাহবুব উল আলম ‘নোট অব ডিসেন্ট’ও দেন বোর্ড সভায়।

এআইইউবিকে কার্যাদেশ দেওয়ার বিরোধিতা করে এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বোর্ডের তৎকালীন আরেক পরিচালক ড. ফাহমিদা খানমও। তিনি জানতে চান, এই কাজ বুয়েট বা নর্থ সাউথকে না দিয়ে কেন এআইইউবিকে দেওয়া হচ্ছে। ওই সময় শাহজাহান মাহমুদ বুয়েটে লম্বা লাইন বলে জানান। সেবার কোনো ধরনের প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডার ছাড়াই মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ১৮৮ টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয় এআইইউবিকে। পরবর্তীকালে অবশ্য টেন্ডারের মাধ্যমে আরও ডিভাইস ক্রয়ে কার্যাদেশ দেওয়া হয় এআইইউবিকে। তবে সেই টেন্ডারে এআইইউবির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান।

রেভিনিউ শেয়ারিংয়ে বাড়তি সুবিধা : একই সঙ্গে এআইইউবিকে দেওয়া হয় রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের বাড়তি সুবিধা। বিভিন্ন টেলিভিশনের জন্য টিআরপি সেবা বাবদ বিএসসিএলের যে আয় হবে, তার ৩ শতাংশ পাবে এআইইউবি। বিএসসিএলের নথি বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাড়ে ৫ মাসে বিএসসিএলের আয় হয়েছে (ভ্যাটসহ) ২ কোটি ৯০ লাখ ৬৬ হাজার ২৫০ টাকা। এই অঙ্কের মূল অর্থের ওপর ৩ শতাংশ হারে রেভিনিউ পাচ্ছে এআইইউবি। তবে বিএসসিএলের এই আয় মাত্র ৫০০টি ডিভাইসের ভিত্তিতে। ডিভাইসের সংখ্যা ৮ হাজারে উন্নীত হলে আয় বাড়বে বিএসসিএল তথা এআইইউবিএরও। পাশাপাশি পূর্বেই ডিভাইস বসানোর মাধ্যমে টেন্ডারে এআইইউবি বাড়তি সুবিধা পেয়েছে বলে মনে করছেন বিএসসিএলের টিআরপি সংশ্লিষ্টরা।

বিএসসিলের সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী ড. শাহজাহান মাহমুদও বিষয়টি আমাদের সময়ের কাছে স্বীকার করেছেন। তিনি গতকাল বলেন, এআইইউবিকে কিছুটা বেশি দেওয়া হয়েছে। তবে আমি চেয়েছিলাম দেশীয় প্রযুক্তিতে কাজটা করব। তখন বুয়েটের কাছে গেলেও তারা আগ্রহ দেখায়নি। প্রতি মুহূর্তে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে তাগাদা দেওয়া হচ্ছিল। কাজটি দ্রুত করার জন্য এআইইউবির একজন অধ্যাপকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি দীর্ঘদিন বুয়েটেই (শিক্ষক) ছিলেন, আমিও বুয়েটের। বোর্ড সভায় এই কথাটিই বলেছিলাম ‘ব্যক্তিগত যোগাযোগ’। স্বার্থান্বেষী মহল এখন এই ব্যবস্থার সমালোচনা করছে। অথচ আমি আশা করেছিলাম এ জন্য স্বীকৃতি পাব, আমাকে পুরস্কৃৃত করা হবে।

টিআরপি ফলাফল নিয়ে অসন্তুষ্ট অ্যাটকো : অন্যদিকে টিআরপি সিস্টেম নিয়ে সন্তুষ্ট নয় এই ব্যবস্থার শীর্ষ অংশীদার টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্স (অ্যাটকো)। বিএসসিএলের বসানো টিআরপি ব্যবস্থার ফলাফল গ্রহণযোগ্য নয় উল্লেখ করে তথ্য ও সম্প্রচার এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছে অ্যাটকো।

গত ৯ সেপ্টেম্বর অ্যাটকো সভাপতি অঞ্জন চৌধুরী এক চিঠিতে লিখেন, দীর্ঘদিন যাবত টিআরপি সেবা পরিচালনায় বিএসসিএল যে রিপোর্টগুলো প্রদান করে আসছে, তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এ ছাড়া তারা মাত্র ২০০ থেকে ৩০০টি সেটটপ বক্সের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অথচ বিগত বিভিন্ন মিটিংয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনায় সময় জানানো হয়েছিল ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজারটি সেটটপ বক্স স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া দক্ষ জনবলেরও যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে এই কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য। পাশাপাশি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সাময়িক বন্ধ থাকা টেলিভিশন চ্যানেলের সময়কার রিপোর্ট অযৌক্তিক বলেও উল্লেখ করা হয় চিঠিতে।