আমানতের বিপরীতে ঋণ দেখিয়ে ২ হাজার কোটি টাকা লুট
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের কর্ণদার মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা স্থায়ী আমানতের (এফডিআর/এমটিডিআর) টাকার উৎস গোপন করতে তৎপর হয়ে ওঠেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিনিষেধের মধ্যেই বেসরকারি ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা তুলে নেয় তারা। সেই টাকা লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। মোহাম্মদ সাইফুল আলম, তার ভাই রাশেদুল আলম, শ্যালক আরশাদ মাহমুদ ও বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের নামে ইউনিয়ন ব্যাংকের কয়েকটি শাখায় এসব টাকা স্থায়ী আমানত (এমটিডিআর) করে রাখা হয়েছিল। এসব টাকা তুলতে সহায়তা করেছে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। শুধু তাই নয়, এস আলমের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ১৯ গ্রাহকের এমটিডিআরের বিপরীতে সীমাতিরিক্ত ঋণ দেওয়ার (বিনিয়োগ) ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে কোনো এমটিডিআর না থাকার পরও বিপুল অঙ্কের বেনামি ঋণ (বিনিয়োগ) দেওয়ার অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মাধ্যমে ব্যাংকের প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি পরিচালিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে এমন অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
লেয়ারিং বলতে প্লেসমেন্টকৃত অর্থ পর্যায়ক্রমে জটিল লেনদেনের মাধ্যমে বিভিন্ন স্তরে সরানো বা স্থানান্তরের প্রক্রিয়াকে বুঝায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, যে তিনটি উপায়ে মানিলন্ডারিং হয়ে থাকে তার মধ্যে অন্যতম লেয়ারিং। এই প্রক্রিয়া অর্থের উৎস গোপন বা লুকানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
পরিদর্শন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এস আলম গ্রুপের মালিক, তাদের পরিবাবের সদস্য এবং মালিক পক্ষের আত্মীয়স্বজনের নামে ইউনিয়ন ব্যাংকে থাকা মুদারাবা টার্ম ডিপোজিট (এমটিডিআর) নগদায়ন করে ওই সব অর্থ লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে সরিয়ে নেওয়া হয়। পরিদর্শন প্রতিবেদনে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসার পরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেকটি বিভাগ থেকে তাদের তারল্য সংকট মোকাবিলায় আন্তঃব্যাংক থেকে পাওয়া ৩৫০ কোটি টাকার ধারের গ্যারান্টি না দেওয়ার পক্ষে মত দেওয়া হয়। তবে সেই মতামতকে উপেক্ষা করে একজন ডেপুটি গভর্নর ব্যাংকটির অনুকূলে গ্যারান্টির অনুমোদন করেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আমানতকারীদের অর্থ সরিয়ে নেওয়ার জন্য ব্যাংকটির পলাতক এমডি এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরী, এইচ আর প্রধান, বিনিয়োগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা প্রধান, বিনিয়োগ প্রশাসন প্রধান, প্রধান ঝুঁকি কর্মকর্তা, ট্রেজারি প্রধান, প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা, ক্যামলকো, সংশ্লিষ্ট শাখা প্রধান এবং শাখার বিনিয়োগ প্রধান সরাসরি জড়িত।
এসব গুরুতর অনিয়মের প্রত্যক্ষ মদদদাতা ছিলেন এমডি এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরী। এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য পলাতক এমডি এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীর মোবাইল ফোনে কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকের দায়িত্বশীল অন্য কর্মকর্তারাও কথা বলতে রাজি হননি।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ইউনিয়ন ব্যাংক হলো পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর একটি। ব্যাংকটির প্রায় ৬৫ শতাংশ ঋণ একাই নিয়েছে এই গ্রুপ, যা পরিমাণে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে কাল্পনিক লেনদেনের মাধ্যমে, যার বিপরীতে কোনো জামানত নেই। আবার ঋণ প্রদানের পর থেকে কোনো কিস্তিও জমা করা হয়নি। এ ছাড়া ব্যাংকটির মোট ঋণের ৪২ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়ছে বলে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তারা জানিয়েছে, খেলাপি ঋণ ৪ শতাংশের কম।
পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, এস আলম গ্রুপের কর্ণদার মোহাম্মদ সাইফুল আলম গত ১১ আগস্ট ইউনিয়ন ব্যাংকের মুরাদপুর ও বন্দরটিলা শাখায় থাকা অ্যাকাউন্ট হতে নগদায়ন করে তার খাতুনগঞ্জে এসএনডি (শর্ট নোটিশ ডিপোজিট) হিসাবে স্থানান্তর করে। পরবর্তীতে তা আগ্রাবাদ শাখার এস আলম অ্যান্ড কোম্পানি নামীয় হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। একই দিনে ৪ কোটি ২০ লাখ টাকা ডিটি রোড শাখায় রাসেল এন্টারপ্রাইজ নামীয় প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর এবং অবশিষ্ট ৪ কোটি টাকা একই ব্যাংকের বহদ্দার হাট শাখার গ্রাহক ক্রোভ ট্রেডিং নামীয় প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে এমটিডিআর করা হয়। শুধু এস আলম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ সাইফুল আলমের হিসাব থেকে টাকা উত্তোলন বা স্থানান্তর হয়নি। তার ভাই রাশেদুল আলম ও শ্যালক আরশাদ মাহমুদের হিসাব থেকে টাকাও নগদায়ন করা হয়। পরে তা বিভিন্ন হিসাবে জমা করা হয়।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাশেদুল আলমের কদমতলী শাখার এমটিডিআর হিসাবে থাকা ৮ কোটি টাকা গত ১৪ ও ১৮ আগস্ট নগদায়ন করে একই শাখায় আজিজুন্নেসা ও রাশেদুল করিম চৌধুরীর নামে রাখা হয়। একইভাবে শ্যালক আরশাদ মাহমুদের হিসাবে থাকা ৪ কোটি ২২ লাখ টাকা ২৮ আগস্ট ব্যাংকটির লিচুবাগান শাখায় নগদায়ন করে বিভিন্ন নামে পে-অর্ডার ইস্যু করা হয়। এ ছাড়া এস আলমসংশ্লিষ্ট আনসারুল আলম চৌধুরীর এমটিডিআর হিসাব হতে দেড় কোটি টাকা গত ২০ আগস্ট ‘ও আর নিজাম’ শাখা হতে নগদায়ন করে তা একই দিনে রোকেয়া বেগম ও হাসনা হেনার নামে জমা করা হয়। তাছাড়া গোলাম সরোয়ার চৌধুরীর ৩ কোটি ২৬ লাখ টাকার এমটিডিআর গত ১৮ আগস্ট খাতুনগঞ্জ শাখা হতে নগদায়ন করে এস আলম কোল্ড রোল স্টিল অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়েছে।
ব্যক্তি হিসাব ছাড়াও গ্রুপসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের টাকাও তুলে নেন তারা। আবার ওইসব হিসাবের বাকি অর্থ বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে এমটিডিআর করে রাখা হয়। প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, এস আলম গ্রুপ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান টপ টেন ট্রেডিং হাউসের খাতুনগঞ্জ, আগ্রাবাদ ও মুরাদপুর শাখার হিসাবের জমা ৩২ কোটি ২৭ লাখ টাকার মধ্যে গত ১১ আগস্ট ১২ কোটি ২৯ লাখ টাকার এমটিডিআর নগদায়ন করে খাতুনগঞ্জ শাখার মাধ্যমে বিভিন্ন নামে পে-অর্ডার ইস্যু করে উত্তোলন করে। বাকি অর্থ আগ্রাবাদ ও মুরাদপুর শাখায় ১৫ আগস্ট বিভিন্ন ব্যক্তির নামে পুনরায় ৫০টি এমটিডিআর হিসাব খুলে রাখা হয়।
জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংকটির গুলশান শাখায় বিনিয়োগ স্থিতি ছিল ৬০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। গ্রাহকের নিকট বিপুল পরিমাণ অনাদায়ী বিনিয়োগ পাওনা থাকা সত্ত্বেও তড়িঘড়ি করে এমটিডিআর নগদায়ন করে উত্তোলন সুবিধা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে পরবর্তীতে তুলে নেওয়ার সুযোগ করে দেয়।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, এস আলম গ্রুপের মালিক বা মালিকপক্ষের আত্মীয়স্বজন গত ৫ আগস্টের পর ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে এসব টাকা উত্তোলন এবং স্থানান্তর করে। আবার কিছু অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর উত্তোলন করা হয়। আগস্টের শেষের দিকে এস আলম গ্রুপের নামে-বেনামে থাকা সব ঋণ ও ঋণসুবিধা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নির্দেশনা ভঙ্গ করে ব্যাংক ও শাখা ব্যবস্থাপনা অর্থ তুলতে সহায়তা করে, যা আমানতকারীদের স্বার্থপরিপন্থি কাজ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে উল্লেখ করেছে পরিদর্শন দল।
এফডিআরের বিপরীতে ঋণ দেখিয়ে ২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ : এস আলম গ্রুপ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এমটিডিআরের বিপরীতে বিপুল পরিমাণের সীমাতিরিক্ত বেনামি বিনিয়োগের অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, এমটিডিআরের বিপরীতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এমটিডিআর লিয়েন রেখে ফেস ভ্যালুর সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারবে। তবে নিয়ম ভঙ্গ করে ১৯টি গ্রাহকের ৭৯ কোটি ৩০ লাখ টাকার এমটিডিআরের বিপরীতে বিনিয়োগ স্থিতি ৮৫৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আবার কোনো প্রকার এমটিডিআর না থাকা সত্ত্বেও অনুমোদন ছাড়া বিনিয়োগ স্থিতি এক হাজার ১৭৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। ফলে এ খাত থেকে এস আলম হাতিয়ে নিয়েছে ২ হাজার ২৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
জানা যায়, এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলমের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন মোকাম্মেল হক চৌধুরী। সম্প্রতি এমডির বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের খবর বের হলে নিরুদ্দেশ হন তিনি। ব্যাংকের এমডি পদে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) শফিউদ্দিন আহমেদকে। নানা অনিয়মের কারণে আর্থিক বিপর্যয়ে পড়া এই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গত আগস্ট মাসে পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংকটি এস আলমমুক্ত হয়। ব্যাংকটিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে পাঁচজন স্বতন্ত্র পরিচালক।