সাজিদ-নোমান: এলেন, দেখলেন, জয় করলেন

জিহাদুল ইসলাম
২৬ অক্টোবর ২০২৪, ২০:১৪
শেয়ার :
সাজিদ-নোমান: এলেন, দেখলেন, জয় করলেন

ভিনি, ভিডি, ভিসি— ল্যাটিন এই শব্দগুচ্ছের বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায়—এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। খ্রিস্টপূর্ব ৪৭ সালের দিকে এই কথাটি বলেছিলেন জুলিয়াস সিজার। চার ঘণ্টারও কম সময়ে পন্টুস রাজ্য দখলের পর রোমান সিনেটের উদ্দেশে দেওয়া এক চিঠিতে জয়ের বর্ণনা করতে এই তিন শব্দ ব্যবহার করেছিলেন তিনি। চাইলে পাকিস্তানের দুই স্পিনার সাজিদ খান ও নোমান আলীও এভাবে বলতে পারেন। পাকিস্তানের হয়ে এই দুজন গত দুই সপ্তাহে যা করেছেন তা পাকিস্তানের হয়ে সম্রাজ্য জয়ের মতোই।

 ঘরের মাঠে প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে টেস্ট সিরিজ জিততে পারছিল না পাকিস্তান। ২০২১ সালের শুরুর দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ জেতে তারা। এরপর অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও বাংলাদেশের বিপক্ষে খেললেও জয়ের মুখ দেখেনি এক সময়ের পরাক্রমশালী দলটি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সদ্য সমাপ্ত টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচেও ইনিংস ব্যবধানে হেরে হতাশার ধারা বজায় রাখার ইঙ্গিত দেয় শান মাসুদের দল। তবে স্কোয়াডে বড়সড় পরিবর্তন এনে দ্বিতীয় টেস্টের দল সাজায় তারা। সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানো শুরু। দ্বিতীয় টেস্ট জয়ের পর তৃতীয় টেস্টেও স্বাগতিকরা তুলে নেয় দাপুটে জয়। যার পুরোধায় আছেন সাজিদ ও নোমান।

 ২০১৫ সালের পর এই প্রথম ইংলিশদের হারাল পাকিস্তান। গত বছর পাকিস্তানের লাল বলের দায়িত্ব নেন শান মাসুদ। এরপর অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের বিপক্ষে ধবলধোলাই হয় তার দল। অবশেষে সাজিদ-নোমানে ভর করে প্রথম সিরিজ জয়ের স্বাদ পেলেন তিনি। তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজে প্রথম ম্যাচ হেরেও সিরিজ জয়ের মতো কীর্তি দ্বিতীয়বারের মতো গড়ল পাকিস্তান। তার আগের কীর্তিটি ২৯ বছর আগের। ১৯৯৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এই কীর্তি গড়েছিল দলটি।

 সিরিজের প্রথম টেস্টে ইনিংস ব্যবধানে হারের পর দলের বাইরে রাখা হয় তিন অবিচ্ছেদ্য সদস্য হিসেবে বিবেচিত বাবর আজম, শাহিন আফ্রিদি ও নাসিম শাহকে। আকস্মিকভাবেই দলে ডাক পান নোমান ও সাজিদ। তারা নিজেরাও হয়ত বিশ্বাস করতে পারেননি দলে সুযোগ মিলতে পারে তাদের।

 নোমান ও সাজিদের মিলিত বয়স ৬৯। এর মধ্যে নোমানের বয়স ৩৮ ছাড়িয়েছে। ২০২১ সালে ৩৫ বছর বয়সে পাকিস্তান দলের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অভিষেক হয় এই বাঁহাতি স্পিনারের। ক্যারিয়ারের শেষলগ্নে এসে অভিষেক হলেও দলে নিয়মিতই ছিলেন নোমান। তবে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে দলের বাইরে পাকিস্তানের সিন্ধুতে জন্ম নেওয়া এই স্পিনার। এ বছরের জানুয়ারির দিকে অস্ট্রেলিয়া সফরে দলের সঙ্গে থাকলেও পেটের ব্যথায় না খেলেই দেশে ফিরতে হয় তাকে। এরপর প্রথম শ্রেণির কোনো ক্রিকেটেও দেখা যায়নি তাকে। তাই পাকিস্তানের টেস্ট দলে হঠাৎ ডাক পাওয়াটা তার জন্য বিস্ময় হয়েই এসেছে। সুযোগ লুফে নিয়ে কী সুন্দরভাবেই না তার ব্যবহার করলেন নোমান!

 নোমানের মতোই ক্যারিয়ারের শেষের দিকে এসে অভিষেক হয় সাজিদের। বর্তমানে ৩১ পার করা এই অফস্পিনারের অভিষেকও হয় ২০২১ সালে। ৩ বছরের ক্যারিয়ারে ইংল্যান্ড সিরিজের আগে মাত্র ৮ ম্যাচ খেলেছেন তিনি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আকস্মিকভাবে ডাক পাওয়ার আগে সবশেষ খেলেছেন অস্ট্রেলিয়া সিরিজে। সেই সিরিজে মাত্র ১ ম্যাচেই সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। সেখানেও উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারেননি, নিয়েছেন মাত্র ৩ উইকেট। ঘরোয়া ক্রিকেটেও দেখানোর মতো কিছু করতে পারেননি। ক্যারিয়ারে এর আগে মাত্র একবারই কোনো ম্যাচে পাঁচের বেশি উইকেট নিতে পেরেছেন (বাংলাদেশের বিপক্ষে)। সেই সাজিদই দুই ম্যাচে সুযোগ পেয়ে একবার ৯ ও একবার শিকার করলেন ১০ উইকেট। নোমানের সঙ্গে জুটি বেধে ধসিয়ে দিয়েছেন ইংল্যান্ডকে। হয়েছেন সিরিজের সেরা ক্রিকেটার।

---সিরিজে সাজিদের চেনা উদযাপন। ছবি: পিসিবি

 ঘরোয়া ক্রিকেটে সুযোগ পেতেই সাজিদকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ২৩ বছর পর্যন্ত। জীবনে অনেক কাঠখড় পোহানোর পর পাকিস্তান ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছেন নিজেকে। অল্প বয়সে হারিয়েছেন বাবাকে। এরপর সামান্য কিছু অর্থের জন্য খেপ ক্রিকেট খেলে বেড়িয়েছেন খাইবার পাখতুনখোয়ায় জন্ম নেওয়া এই ক্রিকেটার, বিক্রি করেছেন সেলফোন। সেই নোমানেই যেন সজীবতা ফিরে পেয়েছে পাকিস্তান। ইংলিশ স্পিনার রেহান আহমেদের করা বল ব্যাটে লাগার পর চোয়ালে লেগেছিল সাজিদের। রক্তে জার্সি ভিজলেও চেহারায় ছিল আত্মবিশ্বাসের ছাপ, অনন্য অসাধারণ কিছু করে দেখানোর চাহনি।

 ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাকিস্তানের শেষ দুই টেস্টে সাজিদ আর নোমান প্রথম ও দ্বিতীয় ইনিংস যেন ভাগ করে নিয়েছিলেন। মুলতানে দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে সাজিদের শিকার ৭ উইকেট, নোমানের ৩টি। একই টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে সাজিদের ২টি, নোমানের ৮টি! দ্বিতীয় টেস্টেও প্রায় একই চিত্র। রাওয়ালপিন্ডি টেস্টের প্রথম ইনিংসে সাজিদ শিকার করেন ৬ উইকেট, নোমান ৩টি। আর দ্বিতীয় ইনিংসে সাজিদ ৪টি, নোমান ৬টি। দুই টেস্টে ইংলিশদের ৪০ উইকেটের মধ্যে ৩৯টি-ই এই দুজনের!

---সাজিদকে অনুকরণ করে উদযাপন করেছেন নোমানও। ছবি: পিসিবি

 ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সাজিদ-নোমানের বোলিং বোলিং আধিপত্য আরও একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যায়। সিরিজে দুজনে একটানা বোলিং করেছেন ৮৯.৫ ওভার। মুলতানে দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে শেষ ১৪.২ ওভার বোলিং করেছেন এই দুজন। এরপর দ্বিতীয় ইনিংসে টানা ৩৩.৩ ওভার বোলিং করেন এই দুজন। আর কাউকে এই ইনিংসে বোলিংই করতে হয়নি। তৃতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে এই দুজন বোলিং করেছেন টানা ৪২ ওভার! শেষ ২ টেস্টে ইংল্যান্ড ব্যাটিং করেছে ২০৬ ওভার ৩ বল। সেখানে সাজিদ-নোমানই করেছেন ১৮১ ওভার ৩ বল। মাত্র ২৫ ওভার করেছেন অন্য সবাই মিলে।

শুধু বোলিং নয়, ব্যাটিংয়েও দুঃসময়ে দলের হাল ধরেছেন সাজিদ-নোমান। দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে সাজিদ ২ রান করে আউট হলেও নোমান করেছেন মূল্যবান ৩২ রান। দ্বিতীয় ইনিংসে আবার প্রথম ইনিংসের ঘাটতি পুষিয়ে দিয়েছেন সাজিদ। নোমান ১ রান করে আউট হলে দশ নম্বরে নেমে সাজিদ করেন ২২ রান। দ্বিতীয় টেস্টে ব্যাট হাতে আরও বীরত্ব দেখান এই দুজন। প্রথম ইনিংসে দলের দুঃসময়ে নয় ও দশ নম্বরে নেমে নোমান ও সাজিদ করেছেন যথাক্রমে ৪৫ ও ৪৮ রান। যা দলের হয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ রান।