ধুঁকছেন উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগীরা

আজাদুল আদনান
২৬ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ধুঁকছেন উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগীরা

কমিউনিটি ক্লিনিকে গত বছর থেকে ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য বিনামূল্যে মেটফরমিন এবং উচ্চরক্তচাপের রোগীদের অ্যামলোডিপিন দেওয়া হচ্ছে। এসব ওষুধ পেতে হলে উপজেলা হাসপাতাল কিংবা এনসিডি (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) কর্নারের ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র লাগে। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারের (সিএইচসিপি) ব্যবস্থাপত্র লেখার সক্ষমতা না থাকায় এর জন্য দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে উপজেলায় ছুটতে হয় রোগীদের। এতে বিনামূল্যের ওষুধ পেতে খরচ হয়ে যায় কয়েকশ টাকা। যা ভোগান্তিতে ফেলেছে ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপের রোগীদের। ভোগান্তি নিরসনে কমিউনিটি ক্লিনিকেই ব্যবস্থাপত্র এবং নিয়মিত ওষুধ পেতে চান রোগীরা। উজিরপুর উপজেলার কয়েকটি কমিউনিটি ক্লিনিক, উপজেলা হাসপাতাল ঘুরে এবং রোগীদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

উজিরপুর উপজেলার ভবানীপুরের বাসিন্দা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জাকির ব্যাপারী (৬২) আমাদের সময়কে বলেন, চার বছর ধরে তিনি ডায়াবেটিসে ভুগছেন। নিয়মিত ওষুধ খেতে না পারায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নেই। এক সময় কমিউনিটি ক্লিনিকেই ওষুধ দেওয়া হতো। এখন ওষুধ পেতে হলে উপজেলায় আসতে হয়। ডাক্তার প্রেসক্রিপশন দেয়, তারপর সেটা নিয়ে এনসিডি কর্নার থেকে ওষুধ নিতে হয়। তিনি জানান, উপজেলায় আসতে অনেক সময় ব্যয় এবং অর্থ খরচ করতে হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকে ব্যবস্থাপত্র এবং নিয়মিত ওষুধ সরবরাহের দাবি জানান তিনি।

একই এলাকার উচ্চরক্তচাপের রোগী মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন (৭০) বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকে ঠিকমতো ওষুধ পাওয়া যায় না। শুরুতে এক মাসের দিলেও পরে সর্বোচ্চ ১৫ দিনের দেয়। ফলে মাঝপথেই ওষুধ ছেড়ে দেওয়া লাগে। বাইরে কিনতে অনেক টাকা লাগে। তিনি জানান, গত তিন মাসে ওষুধ পাননি। এতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ওষুধ সংকটের দ্রুত সমাধান চান তিনি।

শুধু এই দুই রোগী নন, হাতের নাগালে চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ না পাওয়ায় ৫৭ শতাংশ মানুষের ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। বাকি ৪৩ শতাংশেরও নিয়ন্ত্রণে নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর থেকে কমিউনিটি ক্লিনিকে ডায়াবেটিসের মেটফরমিন (৫০০ মিলি) এবং উচ্চরক্তচাপের অ্যামলোডিপিন (৫ মিলি) দেওয়া শুরু করেছে সরকার। এসব ওষুধ পেতে উপজেলা হাসপাতাল কিংবা এনসিডি কর্নারের ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র

লাগবে। কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের (সিএইচসিপি) ব্যবস্থাপত্র লেখার সক্ষমতা না থাকায় এমন জটিলতা তৈরি হয়েছে। ওষুধ পেতে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে উপজেলায় ছুটতে হয় রোগীদের। এতে কয়েকশ টাকা খরচ হয়ে যায়। হাতের নাগালে ওষুধ পেতে এ সমস্যার সমাধান চেয়েছেন রোগীরা।

উজিরপুর উপজেলায় ৩৭টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। উপজেলায় একটি হাসপাতাল। ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপের রোগীদের জন্য সরকারি ছাড়াও বেসরসকারি সংস্থা ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের একটি প্রকল্প চালু রয়েছে। উজিরপুর উপজেলা হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, এনসিডি কর্নারে ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপের রোগীদের চাপ। স্থানীয় পর্যায়ে ওষুধ না পাওয়ায় দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন তারা। এদের বড় অংশেরই ওষুধ খাওয়া অনিয়মিত হয়ে পড়েছে।

চিকিৎসকরা জানান, দিনে শতাধিক রোগী এনসিডি কর্নারে এসে সেবা নেন। ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ শনাক্ত হওয়াদের তিন মাস পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। কিন্তু অধিকাংশ রোগীকেই চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ দেওয়া সম্ভব হয় না। এ ছাড়া চিকিৎসকেরও সংকট রয়েছে।

উপজেলা হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা. রাকিব হাসান বলেন, সারাদেশে ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের হার ৫৭ শতাংশ হলেও এ উপজেলায় ৫৮ শতাংশ। যা পুরো বরিশাল অঞ্চল তো বটেই সারাদেশেই সর্বোচ্চ। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রকল্পের পরও নিয়ন্ত্রণের হার পিছিয়ে। এর পেছনে অন্যতম কারণ চাহিদা ও সময়মতো ওষুধ না পাওয়া।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে কার্যকরি উপজেলা হাসপাতাল ৪২৯টি। এর মধ্যে মধ্যে ৩৬২টিতে রয়েছে এনসিডি কর্নার। এসব কর্নারের অধীনে কয়েক হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে গত বছর থেকে ডায়াবেটিসের ও উচ্চরক্তচাপের ১ হাজার ৫০০ করে ওষুধ সরবরাহ করছে সরকার। যা চাহিদার তুলনায় একেবারে অপ্রতুল। আবার যেসব উপজেলায় এনসিডি কর্নার নেই, সেখানে একমাত্র ভরসা উপজেলা ও জেলা হাসপাতাল। এনসিডি কর্নারে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ও হৃদরোগের সাতটি ওষুধ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ডায়াবেটিসের জন্য মেটফরমিন (৫০০ মিলি গ্রাম) ও গ্লিক্লাজাইড। উচ্চরক্তচাপের জন্য অ্যামলোডিপিন (৫ মিলি গ্রাম), লোজারটেন পটাশিয়াম (৫০ মিলি গ্রাম) এবং হাইড্রোক্লোরোথায়াজাইড। আর হৃদরোগীদের জন্য দেওয়া হচ্ছে অ্যাসপিরিন (৭৫ মিলি গ্রিাম) ও রোজুভাসটেটিন।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ডা. ইকবাল আহমেদ খান আমাদের সময়কে বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকে ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপের যে দুটি ওষুধ দেওয়া হয় তা কেবলমাত্র বিতরণ করতে পারেন সিএইচসিপিরা। কারণ ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার যোগ্যতা তাদের নেই। ফলে করে ওষুধ পেতে রোগীদের ছুটতে হয় উপজেলা হাসপাতালে। এনসিডি কর্নারের সঙ্গে কমিউনিটি ক্লিনিক কীভাবে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করতে পারে, সেটি পথ তৈরি করতে হবে। এজন্য সরকারের একটা নীতিমালা থাকা দরকার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ারের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. ফারুক হোসেন বলেন, ডায়াবেটিসের মতো রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে ওষুধ হাতের নাগালে পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থায় অনেকটা কঠিন। বর্তমানে অনেক রোগী মাঝপথে ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছেন। এটি উদ্বেগজনক।

সরকারের ইসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয় ও বিপণন) মো. জাকির হোসেন বলেন, সম্প্রতি নানা বিষয়ে জটিলতায় ওয়ার্ক অর্ডার পেতে সমস্যা হয়েছে। ফলে সময়মতো ওষুধ সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। আগামী সপ্তাহ থেকে আবার সরবরাহ শুরু হবে। তিনি বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকে উচ্চরক্তচাপের ও ডায়াবেটিসের ওষুধ যাচ্ছে। তবে এই সিদ্ধান্ত নতুন হওয়ায় গত অর্থবছরে কিছুটা জটিলতা ছিল। আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, নিরবচ্ছিন্নভাবে ওষুধের অভাব বহুদিন ধরেই দেখছি। গত তিন মাস ধরে নতুন অপারেশন প্ল্যান (ওপি) বন্ধ রয়েছে। এতে সংকট আরও বেড়েছে। ইডিসিএলকে ওষুধে সরবরাহ ঠিক রাখার পাশাপাশি বরাদ্দ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি উপজেলা হাসপাতালের বরাদ্দে ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপের ওষুধ কিনতে হবে। তিনি বলেন, বিএমডিসির নিয়ম হচ্ছে ডাক্তার ছাড়া উচ্চরক্তচাপের ওষুধ কেউ লিখতে পারবে না। তাই উপজেলা চিকিৎসকের সঙ্গে একটি টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে সিএইচসিপিদের দিয়ে এটি করা যায় কিনা তার ট্রায়াল চলছে। এতে করে সিএইচসিপিরাই ওষুধ দিতে পারবে।