সুশাসন ও জনসেবায় বাধা আন্তঃক্যাডার বৈষম্য
সরকারের সব সেক্টরের পরিকল্পনা প্রণয়ন, নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের কাজ করে সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তারা। তাদের দ্বারা জনসেবা নিশ্চিত হয় সরকারি দপ্তরগুলোয়। কিন্তু আন্তঃক্যাডার কর্মকর্তারা নিজেরাই যখন পদোন্নতি, আর্থিক সুযোগ-সুবিধাসহ নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হন, তখন তাদের মধ্যেই সৃষ্টি হয় চাপা ক্ষোভ। এর ফলে সিভিল সার্ভিসে সুশাসন ও জনসেবা বিঘিœত হয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, যুগের পর যুগ চলতে থাকা বৈষম্য যৌক্তিক নিরসন হওয়া উচিত। একই দবি তুলছেন বৈষম্যের শিকার আন্তঃক্যাডার কর্মকর্তারাও।
জানা যায়, প্রশাসন, পররাষ্ট্র ও পুলিশে কতিপয় ক্যাডার পদ না থাকলেও প্রতিবছর পদোন্নতি হয়, যা অন্যান্য ক্যাডারে নেই। এমনকি উচ্চ আদালতের নির্দেশেও প্রতিকার মিলছে না। অনেক ক্যাডারে সুপারনিউমারারি তো দূরের কথা, গ্রেড-২ পর্যন্ত ওঠারও সুযোগ নেই। একই গ্রেডের চাকরি হলেও জেলা প্রশাসকের তুলনায় নির্বাহী প্রকৌশলী, সিভিল সার্জন, কৃষি কর্মকর্তা, শিক্ষা কর্মকর্তা অতি নগণ্য বলে বিবেচিত হন। তা ছাড়া একজন উপসচিব গাড়ি ক্রয়ের জন্য ৩০ লাখ টাকা সুদমুক্ত ঋণ ও তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসে ৫০ হাজার টাকা পান। সমমানের অন্যান্য ক্যাডারে এসব সুবিধা নেই।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষা ক্যাডারের একজন অধ্যাপক আমাদের সময়কে বলেন, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ অন্যান্য ক্যাডারের সঙ্গে না হওয়ায় আন্তঃক্যাডার সম্পর্ক তেমনভাবে গড়ে ওঠে না এবং চাকরির শুরুতে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ না হওয়ায় চাকরি স্থায়ীকরণ বিলম্বিত হয়। ফলে পদোন্নতিতে এর প্রভাব পড়ে। প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপকরা ৮-১০ বছর একই পদে চাকরি করছেন, যা কর্মস্পৃহা বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তিনি আরও বলেন, ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি প্রদান না করার কারণে বিষয়ভিত্তিক বৈষম্যও সৃষ্টি হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সব পর্যায়ের কর্মকর্তারা। চাকরিতে ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্টের সুযোগ-সুবিধার
অপ্রতুলতাসহ বৈষম্যের কারণে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রভাষক প্রতিবছর শিক্ষা ক্যাডার ছেড়ে অন্য ক্যাডারে, এমনকি নন-ক্যাডারেও চলে যাচ্ছেন। শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা উপসচিব পদে নিয়োগেও বৈষম্যের শিকার হন এবং অন্য ক্যাডারের তুলনায় ব্যাচভিত্তিক অনেক পিছিয়ে থাকছেন, যেটি কাম্য হতে পারে না।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
তথ্য ক্যাডার কর্মকর্তারা জানান, একটি বিশেষ ক্যাডারে সর্বোচ্চ সংখ্যক গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ এর পদ সৃষ্টি করা হলেও এর আনুপাতিক সংখ্যায় নেই অন্য ক্যাডারগুলোয়, এটাই বড় বৈষম্য। পদোন্নতিতে উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের পরিবর্তে বিভিন্ন ক্যাডারের জন্য প্রহসনমূলক কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। আসলে সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তারা একটা ক্যাডারের কাছে জিম্মি। এটা থেকে পরিত্রাণ দরকার
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের জনপ্রশাসন সংস্কারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. ফেরদৌস আরফিনা ওসমান আমাদের সময়কে বলেন, সরকার যাদের জনপ্রশাসন সংস্কারের দায়িত্ব দিয়েছেন। তারা নিশ্চয় এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবেন। শুধু একটি বিশেষ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি-পদায়ন হবে। আর বাকিদের ক্ষেত্রে শূন্যপদ থাকা সাপেক্ষ পদোন্নতি-পদায়ন দেওয়া হয়। এটি বৈষম্য বাড়িয়ে দেয়।
ড. ফেরদৌস আরও বলেন, বৈষম্য নিরসনে পুরো সিভিল সার্ভিসের সংস্কার হওয়া দরকার। বৈশি^ক প্রেক্ষাপটে সিভিল সার্ভিস সাজাতে হবে। অন্যথায় জনগণ যথাযথ সেবা পাবে না।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
আন্তঃক্যাডার বৈষম্য প্রসঙ্গে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের একজন জ্যেষ্ঠা কর্মকর্তা বলেন, প্রতিটি ক্যাডারের ভিন্ন ভিন্ন সার্ভিস রেজল্যুশন আছে। কে কীভাবে কোন পদে পদায়ন, পদোন্নতি পাবেন। বিসিএসে মেধাক্রমে ক্যাডার নির্ধারণ হয়। কোনো ক্যাডারে কাউকে জোর করে সম্পৃক্ত করা বা বাদ দেওয়া হয় না। প্রত্যেকে স্বেচ্ছায় স্ব স্ব ক্যাডারে প্রবেশ করেছেন।
এদিকে ‘ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার’- এই স্লোগানে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের ব্যানারে সিভিল সার্ভিসের ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা সোচ্চার হচ্ছেন। সম্প্রতি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে দেওয়া এক চিঠিতে সংগঠনটি জানায়, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনে গঠিত আট সদস্যের মধ্যে ২৫টি ক্যাডারের কোনো সদস্য নেই। বরং কমিশন প্রধানসহ ছয়জনই একটি ক্যাডারের সদস্য, যারা সিভিল প্রশাসনের বৈষম্য সৃষ্টিকারী। এ ছাড়া ইতোপূর্বেও বৈষম্য নিরসনে তাদের দিয়েই কমিটি গঠিত হয়েছিল। তারা সেই সুযোগে বৈষম্য আরও বৃদ্ধি করেছেন।
এ প্রসঙ্গে সংগঠনের একজন সমন্বয়ক আমাদের সময়কে বলেন, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে ২৫টির প্রতিনিধিত্ব করে। প্রায় ৬০ হাজার কর্মকর্তার মধ্যে ২৫টি ক্যাডারে প্রায় ৫৩ হাজার কর্মকর্তা চাকরি করেন। অথচ এই ২৫টি ক্যাডারকে পাশ কাটিয়ে শুধু একটি ক্যাডারের প্রতিনিধি দিয়ে জনপ্রশসন সংস্কার সম্ভব নয়। সংগঠনের দাবি- জনপ্রশাসন সংস্কার কমিটি পুনর্গঠন করতে হবে। আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের মাধ্যমে সব ক্যাডারের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সিভিল সার্ভিসের বাইরে জনপ্রশাসন বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞকে কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করতে হবে।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
প্রসঙ্গত, বিমানের চেয়ারম্যান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীকে প্রধান করে গত ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনে সদস্য হিসেবে আছেন সাবেক সচিব মোহাম্মদ তারেক ও মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. হাফিজুর রহমান, সাবেক অতিরিক্ত সচিব রিজওয়ান খায়ের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএ ফিরোজ আহমেদ ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি।