সাধ্যের পাতে পুষ্টি ছাঁটাই
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী দৌড়ের সঙ্গে ছুটতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষ। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে টিকে থাকাই দিন দিন কঠিনতর হয়ে পড়ছে। একটি পণ্য কিনতে গিয়ে তালিকা থেকে আরেকটি পণ্য বাদ দিতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সাশ্রয়ী হতে মৌলিক চাহিদাতেও কাঁচি চালাতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। পাত থেকে বাদ পড়ছে প্রয়োজনীয় অনেক খাবারও। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে সুষম খাবারে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। যার প্রভাব শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর পড়ছে। দীর্ঘমেয়াদে কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতার ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
লাগাতার উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির কবলে হাঁসফাঁস করছে স্বল্পআয়ের মানুষ। চলতি বছর আগস্ট মাস থেকে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে সেপ্টেম্বরে ১০ শতাংশের নিচে নেমেছে। কিন্তু গত এপ্রিল থেকে টানা ছয় মাস ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরেই অবস্থান করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যে এমন চিত্র উঠে এসেছে। সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, গত বছরের মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে পৌঁছায়। সে বছর আগস্টে তা আরও বেড়ে সাড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। পরে নভেম্বরে তা ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশে নেমে আসে। চলতি বছরের জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১৪ শতাংশ অতিক্রম করে। গত আগস্টে তা কমে ১১ দশমিক ৩৬ এবং সেপ্টেম্বরে ১০ দশমিক ৪০ শতাংশে নামে। অর্থাৎ বেশ লম্বা সময় ধরে খাদ্যের পেছনে অত্যধিক খরচ করতে হচ্ছে। যার ফলে সাধারণ মানুষের যাপিতজীবন দুরূহ হয়ে পড়েছে।
প্রতি মাসে বাড়ি ভাড়া ও সন্তানের পড়াশোনার মতো অত্যাবশকীয় খরচের পর পরিবারের খাবারের সংস্থান করতে লড়াই করে করে রীতিমতো ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন রাজধানীর কদমতলী এলাকার অটোরিকশাচালক মো. কাশেম মোল্লা। কথা হলে তিনি বলেন, ‘প্রতি মাসে ১৫-১৭ হাজার টাকা আয় থেকে বাড়ি ভাড়া ৭ হাজার টাকা, সন্তানের পড়াশোনায় ৪ হাজার টাকা, অন্যান্য ১-২ হাজার টাকা খরচের পর পকেটে ৫ হাজার টাকাও থাকে না। অবশিষ্ট এই টাকায় এই গরম বাজারে পরিবারের খাওয়ার খরচ কেমনে কি ম্যানেজ করুম বুইঝা পাই না। ঋণ কইরাও কুলায় না।’
কাশেম বলেন, ‘বাদ দিয়ে পারা যাচ্ছে না। বাধ্য হইয়া খাওয়াও কমানো লাগতাছে। মাছ, মাংস, ডিম খাওয়া এক রকম ছাইড়াই দিছি। সন্তানদের ফল কিংবা দুধ-ডিম খাওয়াইতে পারি না। মাছের মধ্যে পাঙাশ আর তেলাপিয়া খাই, যা দাম, তাও হিসাব কইরা খাইতে হয়। চালের খরচ কুলানো যাইতাছে না। তরিতরকারির দাম মেলা।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
স্বল্পআয়ের মতো মধ্যবিত্তরাও সাশ্রয়ী হতে খাদ্যতালিকা ছেঁটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন। বাসাবো এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী মো. এনামুল হক বলেন, বিগত কয়েক বছরে যেভাবে বাজারে দাম বেড়েছে তাতে এখন চাল, ডাল, তেল, নুন কিনতেই পকেট ফাঁকা হয়ে যায়। সেখানে পরিবারকে একটু মাছ-মাংস কিংবা ডিম-দুধ-ফল খাওয়ানো সম্ভব হচ্ছে না। এখন তো ডাল-ভাত, সবজি, কম দামের মাছ খেয়ে দিন কাটানোও ভীষণ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন মানুষের প্রতিদিনের খাবারে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ শর্করা, ১৫ শতাংশ প্রোটিন ও ৩০-৩৫ শতাংশ স্নেহজাতীয় খাবার প্রয়োজন। এর ব্যত্যয় হলে স্বাভাবিকভাবেই তা স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলবে। সুষম খাবারের ঘাটতি হলে বা কম খেলে তা সরাসরি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, বাজারের অবস্থা খুবই খারাপ। অতিমূল্যস্ফীতির ফলে নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। আয়ের তুলনায় ব্যয় বাড়ায় স্বাভাবিকভাবেই স্বল্পআয়ের পরিবারগুলোর ক্রয়ক্ষমতা কমেছে এবং তারা বাধ্য হচ্ছেন খাদ্যতালিকা থেকে মূল্যবান খাবার বাদ দিতে। এর ফলে অনেকের খাদ্যতালিকা থেকে স্নেহ ও প্রোটিনের উৎসগুলো বাদ পড়ছে। এতে পুষ্টির ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এই পুষ্টিবিদ আরও বলেন, কায়িক শ্রমজীবীরা পরিশ্রমের ঘাটতি পূরণ করতে ভাতের ওপর জোর বাড়াবে। এতে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়বে। শিশুরা কম খেলে বা অতিপ্রয়োজনীয় পুষ্টিগুলো না পেলে পুষ্টিহীনতায় ভুগবে, খর্বাকার হয়ে পড়বে। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। এই অপুষ্টি দীর্ঘমেয়াদে দেশের উৎপাদনশীলতার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্বব্যাংকের যৌথভাবে করা ‘শিশু অপুষ্টির মাত্রা ও প্রবণতা’ শীর্ষক বৈশি^ক একটি প্রতিবেদন গত বছর ২৩ মে প্রকাশ হয়েছে। এতে উঠে এসেছে- বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী ২৬ শতাংশ শিশু খর্বকায়। অপুষ্টির শিকার এসব শিশুর সংখ্যা ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার। এদের উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম। অপুষ্টির আরেকটি সূচক কৃশতা। প্রতিবেদন বলছে, দেশের ৫ বছর কম বয়সী ৯ দশমিক ৮ শতাংশ শিশু কৃশকায়। এদের মোট সংখ্যা ১৪ লাখ ৩৮ হাজার। টানা উচ্চ খাদ্যমূল্যস্ফীতির কারণে এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা করছেন দেশের পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ অনেক বেশি বলে জানান বাজার বিশ্লেষক গোলাম রহমান। সাবেক এ বাণিজ্য সচিব বলেন, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মানুষের আয় না বাড়লে প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। জীবনমানের অবনতি ঘটে। নিত্যপণ্যের দাম অসহনীয় পর্যায়ে বাড়লে নিম্নআয়ের পরিবারগুলো খাওয়ার পেছনে খরচ কমাতে বাধ্য হয়। খাদ্যতালিকায় কাটছাঁট করতে হয়। এতে তাদের কেবল শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপরেই নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে শিশুস্বাস্থ্য বেশি ঝুঁকিতে পড়ে। সুষম খাদ্যের অভাব হলে তা মানুুষের কর্মদক্ষতাও কমিয়ে দেয়, যা দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদনশীলতায় প্রভাব ফেলতে পারে।
বর্তমান বাজার চিত্র বলছে- নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা যেসব পণ্যের ওপর নির্ভর করেন, এমন পণ্যের পেছনে ব্যয় প্রতি বছর লাগাতার বেড়েই চলেছে। পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকার পরও মাঝারি ও মোটা চাল থেকে শুরু করে অ্যাঙ্কর ডাল, খোলা তেল, পেঁয়াজসহ প্রায় সব পণ্যের পেছনে খরচ বেড়েছে। মধ্যবিত্তের চাল হিসাবে পরিচিত মাঝারি আটাশ চালের কেজি এখন ৬০-৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সময় এ দামে সরু চাল কেনা গেছে। নিম্নআয়ের মানুষের ভরসা মোটা চালের দামও বাড়তে বাড়তে ৫৫ থেকে ৫৬ টাকায় ঠেকেছে। পেঁয়াজের কেজি ১০০ থেকে ১১০ টাকা। আদা, রসুনসহ মসলার দামে আগুন। রুই-কাতলা-কার্প দূরে থাক, কম দামের পাঙাশ ও তেলাপিয়া কেজিপ্রতি খরচ এখন ২২০ থেকে ২৪০ টাকা।
অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়লে আলু ও সবজির ওপর নিম্নআয়ের মানুষের নির্ভরতা বাড়ে। সস্তার আলু দামি খাবারে পরিণত হয়েছে অনেক আগেই। প্রতি কেজিতে গুনতে হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। নতুন করে সবজি বাজারে আগুন লেগেছে। বাজারে বেশির ভাগ সবজি ১০০ টাকার আশপাশে বিক্রি হচ্ছে। সস্তা পেঁপের কেজি এখন ৫০ টাকা। বেগুন, করলা, বরবটি, ধুন্দল, ঝিঙে ও চিচিঙ্গা, টমেটো, কাকরোল, মুলা, লাউ, চালকুমড়া, কপি, টমেটো- এসব পণ্য এখন নিম্নবিত্তরা এড়িয়ে চলছেন। মধ্যবিত্তদেরও হিসাব করে কিনতে হচ্ছে। এক আঁটি লাল শাকের দাম গিয়ে ঠেকেছে ৩০ টাকায়। বাজারের এমন পরিস্থিতিতে বাজার ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়ে আরও নজর দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে পুরনো কায়দায় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তাতে খুব একটা ফল মিলবে না। উৎপাদন থেকে ভোক্তাপর্যায়ে পৌঁছাতে হাতবদলের সংখ্যা কমাতে হবে। আরেক বড় সমস্যাÑ চাঁদাবাজি, এটি বন্ধ করতে হবে। সরবরাহ ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে হবে। বাজারে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ে যেসব অনিয়ম রয়েছে তা দূর করতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক বাজার নিশ্চিত করতে হবে।