পলাতক ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ রেল

তাওহীদুল ইসলাম
২১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
পলাতক ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ রেল

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথ ডাবল লাইন প্রকল্পে নিযুক্ত চীনা ঠিকাদার কাজ অসমাপ্ত রেখে পালালেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না রেল কর্তৃপক্ষ। অসমাপ্ত কাজের জন্য নতুন ঠিকাদার নিয়োগে দরপত্র প্রক্রিয়ায় হাঁটলেও এখন পর্যন্ত কার্যাদেশের অনুমোদন মেলেনি। ২০১৪ সাল থেকে শুরু হওয়া এ প্রকল্পটি নানা কারণে ঝুলছে। প্রকল্পের সর্বশেষ অনুমোদিত মেয়াদ ২০২৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। বাস্তবে প্রকল্পটি কবে শেষ হবে তা বলা যাচ্ছে না। কারণ এখনও নতুন করে কাজ শুরু করা যায়নি। তা ছাড়া অ্যালাইনমেন্ট নিয়েও সমস্যা কাটেনি। রেলের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ও এলজিইডির জমিসংক্রান্ত সমস্যা বহুদিনের। এ নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক হলেও কার্যকর সুফল মেলেনি। বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী জানান, প্রকল্পটির ক্রয়প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

জানা গেছে, প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক মানুষ ঢাকায় আসেন ট্রেনে চেপে। এ পথে ১৬ জোড়া ট্রেন আসা-যাওয়া করে। সিঙ্গেল লাইন হওয়ায় রেলপথটিকে ডাবল লাইন করতে প্রকল্প নেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে। কিন্তু প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন না করেই সরে গেছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ‘পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না লিমিটেড’। যে কারণে গত বছরের ১৫ মার্চ প্রতিষ্ঠানটিকে ‘টার্মিনেশন নোটিশ’ দেয় রেল। যথাসময়ে চুক্তিপত্রের আওতাভুক্ত কাজের পাওনা পরিশোধ না করা, চুক্তির অতিরিক্ত কাজ এবং চুক্তিবহির্ভূত কাজের মূল্য পরিশোধ না করা এবং প্রকল্পের সাইট (আংশিক) বুঝে না পাওয়ায় ঠিকাদারের কাজ ছেড়ে সরে যাওয়ার কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছে রেলওয়ে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পের মেয়াদ ৪র্থ বার বাড়িয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারিত ছিল। ৫ম বার ব্যয়বৃদ্ধি সম্ভব না হওয়ায় ঠিকাদারের চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো যায়নি। পরে একনেকে ২০২৩ সালের ১৮ এপ্রিল অনুমোদন দেওয়া হয়। নির্মাণকাজ চলাকালে অতিরিক্ত কাজ এবং চুক্তি বহির্ভূত কাজ করানো হয়েছিল। এ ছাড়া প্রকল্পের অ্যালাইনমেন্টের চাষাড়া-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে লেভেল ক্রসিংগেট ‘টি১ থেকে টি২ পর্যন্ত ৩৩০ মিটার’ অংশে ডাবল ট্র্যাক নির্মাণে রেলের জমি কম ছিল। তাই ঠিকাদারকে সাইট বুঝিয়ে দিতে পারেনি রেল। এসব কারণে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারছে না সংস্থাটি। গত বছরের ১৫ মার্চ ঠিকাদারকে টার্মিনেশন নোটিশে বকেয়া পাওনা হিসাবে ১৫ কোটি ৭ লাখ ২২ হাজার ২৯২ টাকা উল্লেখ রয়েছে। ঠিকাদার কাজ শুরু করে ২০১৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। তখন রেল নিয়ে ১৩টি রিট মামলা, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও কোভিড মহামারীর কারণে ঠিকাদারের চুক্তির মেয়াদ ৬ মাস বাড়ে। ঠিকাদার চলে যাওয়ার পর অসমাপ্ত কাজের পরিমাপ নির্ধারণ হয় গত বছরের ২৪ এপ্রিল।

সূত্রমতে, আগের ঠিকাদারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। রেলের একটি পক্ষ বলছে, কাজ ফেলে সরে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কালো তালিকাভুক্ত করার পক্ষে মত দিয়েছেন অনেকে। তবে কেউ কেউ বলছেন, ঠিকাদারকে সময়মতো কাজ বুঝিয়ে দেওয়া যায়নি এটিও ঠিক। তা ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি রেলের কাছে বিল পায়। সব মিলিয়ে ক্ষতিপূরণ চেয়ে উল্টো মামলা করারও সুযোগ আছে। বাস্তবতা হচ্ছে- সর্বনিম্ন দরে কাজ পেয়ে বিপাকে পড়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। লোকসানের কারণে সুযোগ খুঁজতে থাকে ঠিকাদার। যে কারণে সময়মতো সাইট বুঝিয়ে না দেওয়া এবং বিল বকেয়া রাখার সুযোগ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

এদিকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ও রেলওয়ের মধ্যে জমি নিয়ে টানাপড়েন চলে দীর্ঘদিন ধরে। একপর্যায়ে সিঙ্গেল লাইনকে ডাবল লাইন করার উদ্যোগ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান কেন্দ্র করে খোদ রেলভবনে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। রেলওয়ে ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মধ্যে পারস্পরিক ভূমি আদান-প্রদানে এমওইউ সই হয়েছিল। সেখানে বলা হয়, সিটি করপোরেশনের ০.১২ একর জমি ব্যবহারের বিনিময়ে গুদারাঘাটের শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর কদমরসুল ব্রিজ নির্মাণে সিটি করপোরেশনকে ১.৬৩ একর জমি দেবে রেল। ওই সময় কদমরসুল সেতু নির্মাণ প্রকল্পের ডিটেইল ডিজাইন ছিল না। আবার রেলের ডাবল লাইন প্রকল্পের ইয়ার্ড ডায়াগ্রাম সংশোধনের পর্যায়ে ছিল। পরে দেখা যায়, রেলের জন্য ৪ শতাংশ জমি বেশি দরকার। অপরদিকে দেখা যায়, কদমরসুল সেতুর মূল প্রশস্ততা ১২.৮ মিটার। র‌্যাম্প হয়ে রাস্তায় নামার পর দুই অংশে দুটি অতিরিক্ত ওয়ানওয়ে রাস্তার কারণে অ্যাট গ্রেড লেভেলে প্রশস্ততা দাঁড়ায় ২১.৬ মিটার। এরপর প্রশস্ততা আরও বাড়ানোর দরকার হয়। এতে মনে হয়, রেলওয়ে কল্যাণ ট্রাস্টের নির্মাণাধীন মার্কেটের একটি অংশ ভাঙা পড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ট্রাস্টের ১ ও ২ নম্বর মার্কেটসহ অন্যান্য লাইসেন্সধারী। সিটি করপোরেশনের বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী সিরাজউদ্দৌলা রোডের পুব দিকে আরেকটি লেনের রাস্তা আ্যাট গ্রেড করতে হলে আরও স্থাপনা ক্ষতি হবে রেলের। এ জন্য ডিপিপি সংশোধন করতে হবে ক্ষতিপূরণের বরাদ্দ রাখতে। এতে ডিজাইন রিভিউর খরচ কম হবে। সিরাজউদ্দৌলা রোডের দিকে র‌্যাম্পের অ্যালাইনমেন্ট ৪ ফিট ৬ ইঞ্চি শিফট করে নকশা সংশোধনে এলজিইডি ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের বিবেচনা দরকার বলে মনে করছে রেল।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০২২ সালের ১৫ মার্চ চুক্তি বাতিলের জন্য রেলওয়েকে চিঠি দেয় চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এরপর পাওনা পরিশোধের জন্য একাধিক চিঠি দেয়। তাই নতুন দরপত্রে প্যাকেজ ডব্লিউডি-১ চুক্তির অসমাপ্ত কাজ এবং নতুন প্যাকেজ-ডব্লিউডি-৩ একত্রীকরণ করে ডিজাইন, সুপারভিশন, ডিফেক্ট লায়াবলিটির সংস্থান রেখে কার্যাদেশ দেওয়া হচ্ছে। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি ৫টি প্রতিষ্ঠানকে রেসপনসিভ বিবেচনা করে। সার্বিক বিবেচনায় ঢাকা-নারায়নগঞ্জ সেকশনে বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইনের সমান্তরাল একটি ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প (১ম সংশোধিত) প্রকল্পের ওয়ার্কস প্যাকেজ ডব্লিউডি-৩: ‘কনভারসন অব এক্সিসটিং মিটারগেজ লাইন ইন টু ডুয়েলগেজ লাইন অ্যান্ড কমপ্লেশন অব ব্যালেন্স ওয়ার্ক অব নিউ ডুয়েলগেজ লাইন ইন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশন’ কাজে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশের সুপারিশ করা হয়েছে।

এর আগে আগে পূর্ত নির্মাণ প্যাকেজে চীনা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল ২০১৭ সালের ১৯ জুন। চুক্তিমূল্য নির্ধারণ হয় ২৬৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। কাজ শুরুর তারিখ ছিল ওই বছরের ১০ সেপ্টেম্বর। প্রতিষ্ঠানটি ২০২৩ সালের ১৫ মার্চে চুক্তিবাতিলের চিঠি দেয়। কারণ হিসাবে সেখানে দাবি করে, সময়মতো পাওনা পরিশোধ না করা, অতিরিক্ত কাজের বিল পরিশোধ না করা এবং প্রকল্পের সাইট বুঝে না পাওয়া। এ পর্যায়ে ১৮ মাসের বাস্তবায়নকাল বিবেচনায় নতুন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবে রেল।

২০১৫ সালে জিওবি এবং ডিআরজিএ-সিএফ অর্থায়নে ৩৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। ডিপিপিতে বিদ্যমান মিটারগেজ লাইনটি ডুয়েলগেজ রূপান্তরের বিষয়টি বাদ পড়ে তখন। ৬৫৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা বর্তমান প্রাক্কলিত ব্যয়। নতুন দরপত্রে ১২টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এর মধ্য থেকে ৫ প্রতিষ্ঠানকে বিবেচনা শেষে একটি প্রতিষ্ঠানকে রেসপনসিভ করে সংশ্লিষ্ট কমিটি। সংশোধিত প্রকল্পের অগ্রগতি ৪৭.৫০%।