লরেন্স বিষ্ণোই ছাত্রনেতা থেকে কুখ্যাত গ্যাংস্টার

নিজস্ব প্রতিবেদক
২১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
লরেন্স বিষ্ণোই ছাত্রনেতা থেকে কুখ্যাত গ্যাংস্টার

ভারতের মহারাষ্ট্রের প্রবীণ রাজনীতিবিদ বাবা সিদ্দিকীকে হত্যার পর থেকে সবার মুখে মুখে ঘুরছে একটাই নাম- লরেন্স বিষ্ণোই। বর্তমানে ভারতের গুজরাটের সবরমতী জেলে বন্দি; কিন্তু সেখান থেকেই চালাচ্ছেন অপরাধের সাম্রাজ্য। গত দুই বছরে তিনটি বড় খুনের ঘটনায় তার নাম জড়িয়েছে। কানাডার পুলিশও নিজেদের হেফাজতে চাইছে বিষ্ণোইকে। এই গ্যাংস্টারের ভয়েই নিরাপত্তা আঁটোসাঁটো করা হয়েছে বলিউডের ‘ভাইজান’খ্যাত সালমান খানের। অনেক দিন ধরে নায়ককে নিশানা করেছে বিষ্ণোই দল। বিস্তারিত জানাচ্ছেন : শামস্ বিশ্বাস

২০২২ সালে পাঞ্জাবি গায়ক সিধু মুসেওয়ালা হত্যাকাণ্ডে লরেন্স বিষ্ণোইয়ের নাম প্রথম লাইমলাইটে আসে। পরের বছর কানাডায় খালিস্তানপন্থি হরদীপ সিং নিজ্জর খুনেও তার নাম জড়িয়ে যায়। এর পর সম্প্রতি ভারতের মহারাষ্ট্রের সাবেক মন্ত্রী বাবা সিদ্দিকীকে হত্যার পেছনেও বিষ্ণোইয়ের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই গ্যাংস্টারকে নিয়ে আমজনতার মনে ব্যাপক কৌতূহল। ৩২ বছর বয়সী এক যুবক জেল থেকে দুটি দেশের ৩টি বড় অপরাধ ঘটাচ্ছে- এটা মোটেই সাধারণ ব্যাপার নয়!

উত্থান

কুখ্যাত দুষ্কৃতকারী লরেন্স বিষ্ণোইয়ের জন্ম ভারতের পাঞ্জাবে ১৯৯৩ সালে। গায়ের রঙ ব্যতিক্রমী রকমের ফরসা, যাকে প্রায় গোলাপি বর্ণ বলা যায়। ফলে তাকে দেখতে ভারতীয়র চেয়ে ঢের বেশি ইউরোপীয় মনে হয়। উত্তর ভারতে বিষ্ণোই সম্প্রদায়ে লরেন্স নামটা এতটা প্রচলিত নয়। ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ ও প্রশাসক হেনরি লরেন্সের নাম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সেখানকার মানুষ এ নাম রাখেন। ঔপনিবেশিক আমলে হেনরি লরেন্স পাঞ্জাবে কর্মরত ছিলেন।

অবস্থাপন্ন পরিবারের লরেন্স বিষ্ণোইদের পাঞ্জাবের দত্তরানওয়ালি গ্রামে ১০০ একরের বেশি কৃষিজমি রয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক শেষে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন পাঞ্জাবের রাজধানী চণ্ডীগড়ের ডিএভি কলেজে। ২০১১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের (স্টুডেন্স কাউন্সিল) সভাপতি ছিলেন বিষ্ণোই। ওই সময়ে সতীনদরজিৎ সিংহ ওরফে গোল্ডি ব্রারের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তার।

গোল্ডি ব্রারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার পর থেকেই বিষ্ণোইয়ের জীবনে বড় পরিবর্তন আসে। ধীরে ধীরে ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে অপরাধমূলক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়েন। চণ্ডীগড়সহ পাঞ্জাবে চাঁদাবাজির নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দিতে গ্যাং তৈরি করেন বিষ্ণোই ও ব্রার। ২০১৩ সালে এক ছাত্রনেতাকে খুনের ঘটনায় প্রথমবার খবরের শিরোনামে আসে বিষ্ণোইয়ের নাম। পরবর্তী সময়ে কলেবরে বাড়তে শুরু করে দুই গ্যাংস্টারের দলবল। চাঁদাবাজির পাশাপাশি যুক্ত হয় মাদক পাচার, মদের কালোবাজারি, আগ্নেয়াস্ত্রের চোরাচালান ও অর্থের বিনিময়ে খুন।

গ্যাংয়ে রিক্রুটমেন্ট

ভারতের গোয়েন্দাদের দাবি, সামাজিকমাধ্যম যেমন ফেসবুক, ইউটিউব ও ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করে যুবকদের দলে টানার সহজ পদ্ধতি অবলম্বন করছে বিষ্ণোইয়ের দল। সেখানে বিষ্ণোইকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার ছবি বারবার পোস্ট করা হয়। যা দেখে অপরাধমনস্ক বহু যুবক তার গ্যাংয়ে যোগ দিচ্ছেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে।

গ্যাং বাড়ানোর দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো কানাডা পাড়ি দেওয়ার লোভ। পাঞ্জাবের অনেক গরিব যুবকই ভাগ্যের সন্ধানে উত্তর আমেরিকার দেশটিতে পাড়ি জমাতে চান। এদেরই নিশানা করে বিষ্ণোই-ব্রারের দলবল।

ভারতের জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (ন্যাশনাল ইনভেস্টটিগেশন এজেন্সি বা এনআইএ) দাবি, পাকিস্তানে আশ্রয় নেওয়া খালিস্তানি জঙ্গি হরবিন্দর সিংহ রিন্ডা বিষ্ণোই গ্যাংয়ের শুটারদের টার্গেট কিলিংয়ের জন্য ব্যবহার করছে। বিষ্ণোই গ্যাং পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের থেকে টাকা পায় বলেও চার্জশিটে জাতীয় তদন্তকারীরা উল্লেখ করেছেন।

জেল থেকেই অপরাধ

সবচেয়ে বড় কথা হলো- জেল থেকে বিষ্ণোই কাজ করছেন। কিন্তু কীভাবে? তার কি কোনো গডফাদার আছে? ২২ বছর বয়স থেকে জেলে। কিন্তু ১০ বছরেও দাপট কমেনি এক চুলও। কোথা থেকে এত সাহস পান?

জেলে লরেন্স বিষ্ণোইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা এক ভারতীয় পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে হিন্দুস্তান টাইমসকে বলেছেন, অন্যান্য গ্যাংস্টারের মতো বিষ্ণোইয়ের কোনো গডফাদার নেই। নিজেকেই সে নিজের জীবনের নায়ক মনে করে।

বিষ্ণোইকে কখনোই এক জেলে বেশিদিন রাখা হয় না। কিছুদিন পরপর জেল বদলানো হয়। তা ছাড়া জেলের ভেতরেও একা থাকেন না বিষ্ণোই। সব সময় নজরদারি চলে।

এনআইএ’র চার্জশিট অনুযায়ী, বিষ্ণোই গ্যাংয়ে রয়েছে ৭০০ শুটার। সুপারি কিলিংয়ে (টাকা নিয়ে খুন) যারা সিদ্ধহস্ত। এই ভাড়াটে খুনির দল সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে রয়েছে পাঞ্জাবে। সেখানে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের ৩০০ শুটার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বলে দাবি এনআইয়ের। জিজ্ঞাসাবাদে গ্যাংস্টার নিজেই একবার বলেছিলেন, যে কোনো দেশে যে কোনোরকম অপারেশন তিনি চালাতে পারেন। শুধু সেই দেশে ভারতীয় যুবক থাকলেই হবে।

উল্লেখ্য, গ্যাংস্টার বিষ্ণোই এবং গোল্ডি ব্রারের যুগলবন্দিকে ইতোমধ্যেই ১৯৯৩ সালের মুম্বাই বিস্ফোরণের মাস্টারমাইন্ড দাউদ ইব্রাহিম কাসকরের তৈরি ‘ডি কোম্পানি’র সঙ্গে তুলনা করেছেন এনআইএর গোয়েন্দারা। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে যাদের নামে কাঁপত গোটা মুম্বাইসহ মহারাষ্ট্রের ফিল্মি দুনিয়া থেকে নামি শিল্পপতিরা।

সালমান খানকে হত্যার চেষ্টা

এনসিপি (জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টি) নেতা তথা মহারাষ্ট্রের সাবেক মন্ত্রী বাবা সিদ্দিকীকে গুলি করে হত্যা করার দায় স্বীকার করেছে লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাং। একই সঙ্গে সাফ জানিয়ে দেয়, সালমান খানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কারণেই এই চরম পরিণতি।

লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাংয়ের তরফ থেকে একাধিকবার হুমকি পেয়েছেন সালমান খান। চলতি বছরের ১৪ এপ্রিল বান্দ্রায় তার বাসভবনের সামনে গুলিও চলে।

সালমান খান এবং লরেন্স বিষ্ণোইয়ের ঝামেলার সূত্রপাত ১৯৯৮ সালে। ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’ সিনেমার শুটিংয়ের সময়ে যোধপুরে একটি কৃষ্ণসার হরিণ হত্যায় অভিযুক্ত হন সালমান খান। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন। তবে বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের লরেন্স শপথ করে, তাদের ধর্মে পবিত্র কৃষ্ণসার হরিণ হত্যার বদলা নিয়েই ছাড়বেন।

‘ডাব্বা কলিং’

লরেন্স বিষ্ণোইর হুমকি ফোন বা চাঁদাবাজিসংক্রান্ত তদন্তের কিনারা করতে গিয়ে এক প্রকার হিমশিম খেতে হচ্ছে ভারতের তদন্তকারীদের। আর তাতেই জানা গেছে নতুন এক অপরাধ পদ্ধতির নাম ‘ডাব্বা কলিং’।

এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ব্যবসায়ীদের থেকে টাকা তোলে মূলত বিদেশে বসবাসকারী গ্যাংস্টাররা। ‘ডাব্বা কলিং’ পদ্ধতি ব্যবহার করে ব্যবসায়ীদের থেকে টাকা তোলে মূলত বিদেশে বা জেলে বসবাসকারী গ্যাংস্টাররা।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লরেন্সের মতো গ্যাংস্টাররা প্রথমে ঠিক করে যে, কোন বিত্তশালীর থেকে টাকা চাওয়া হবে। এর পর টাকা তুলতে দেশে থাকা তাদের দালালদের কাজে লাগায় ওই অপরাধীরা। গ্যাংস্টারের স্থানীয় সহযোগীরা প্রথমে মোবাইলের ইন্টারনেট ব্যবহার করে ‘টার্গেট’কে ফোন করেন। এর পর অন্য একটি মোবাইল থেকে ফোন করা হয় বিদেশে বা জেলে বসে থাকা বস্?কে।

দুটি ফোনই স্পিকারে দিয়ে পাশাপাশি রেখে দেওয়া হয়। এর পর গ্যাংস্টার বিত্তশালী টার্গেটকে ‘প্রটেকশন মানি’ বা অন্য কোনো সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করে টাকা দেওয়ার কথা বলে। কিন্তু দুজনের মধ্যে সরাসরি কথা হয় না।

যেহেতু গ্যাংস্টারের মোবাইল থেকে সরাসরি ফোন আসে না, তাই তদন্তকারীরা প্রমাণও হাতে পায় না।

ভারতীয় এজেন্টদের কেউ কেউ বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত!

দক্ষিণ এশিয়ায় স্বার্থসিদ্ধিতে লরেন্স বিষ্ণোইয়ের দুষ্কৃতকারী দলকে কাজে লাগায় ভারত। এমনই চাঞ্চল্যকর অভিযোগ কানাডা পুলিশের। অভিযোগ, কুখ্যাত অপরাধীদের কাজে লাগিয়েই কানাডায় দক্ষিণ এশিয়া এবং খলিস্তানপন্থিদের গতিবিধির ওপর নজর রাখে ভারত।

কানাডা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তদের দাবি, বিশেষ করে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে ভারতীয় এজেন্টদের। অভিযোগ, কানাডাবাসী দক্ষিণ এশীয়দের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে তারা নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িতদের সাহায্য নেন। এমনকি কখনো কখনো চাঁদাবাজি থেকে খুনÑ সবই করানো হয় তাদের মদদে।

বিষ্ণোইয়ের জীবনকে নিয়ে ওয়েব সিরিজ

কুখ্যাত গ্যাংস্টার লরেন্স বিষ্ণোইয়ের জীবন নিয়ে নতুন একটি ওয়েব সিরিজ তৈরি হতে যাচ্ছে, যার নাম রাখা হয়েছে ‘লরেন্স-আ গ্যাংস্টার’। ফায়ার ফক্স প্রযোজনা সংস্থা সিরিজটি নির্মাণ করছে এবং ইতোমধ্যে ইন্ডিয়ান মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশন থেকে অনুমোদন পেয়েছে। সিরিজে লরেন্সের জীবনের নানা কীর্তি তুলে ধরা হবে, বলা যেতে পারে একেবারে রগরগে থ্রিলার তৈরির কথা ভাবছে প্রযোজনা সংস্থা।

নায়ক হিসেবে কাকে দেখা যাবে তা এখনও ঠিক হয়নি, তবে শোনা যাচ্ছে, দিওয়ালিতে সিরিজের প্রথম পোস্টার প্রকাশ হবে।

বিষ্ণোইয়ের ‘হিট লিস্ট’

ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ সূত্রে জানা গেছে, লরেন্স বিষ্ণোইয়ের হিট লিস্টে সালমান খান ছাড়াও বেশ কিছু পরিচিত ব্যক্তির নাম রয়েছে। এই তালিকার রয়েছে মহারাষ্ট্রের রাজনীতিবিদ জিশান সিদ্দিকী (বাবা সিদ্দিকীর ছেলে)। এ ছাড়া কৌতুকশিল্পী মুনাওয়ার ফারুকীও রয়েছেন, যাকে হত্যার মাধ্যমে বিষ্ণোই ‘ডন’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে চেয়েছিলেন। আরও আছেন গ্যাং প্রতিদ্বন্দ্বী কৌশল চৌধুরী এবং সাবেক সহযোগী গোল্ডি ব্রার।