পুরনো বৃত্তেই বন্দি বাজার

রেজাউল রেজা
১৬ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
পুরনো বৃত্তেই বন্দি বাজার

বাজারে এক এক করে সব নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। মাছ-মাংস আগেই বিলাসী পণ্যের তালিকায় চলে গেছে। ভালো উৎপাদন সত্ত্বেও উচ্চমূল্যের জেরে পেঁয়াজ ও আলু কিনতে হচ্ছে খুবই হিসাব করে। বন্যার অজুহাতে বেড়েছে অবশ্য প্রয়োজনীয় চালের দাম। একই অজুহাতে ডিমের দামও বেড়ে আকাশচুম্বী হয়েছে। নতুন করে আগুন লেগেছে তরিতরকারির বাজারে। দাম বেড়ে বেশির ভাগ সবজি একশ টাকার আশপাশে বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য নিত্যপণ্যেও বাড়তি মূল্যের চাপ সামাল দিতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছে দেশের সাধারণ মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারের তরফে পণ্যের যৌক্তিক দাম বেঁধে দেওয়া, আমদানির অনুমতি ও শুল্ক কমানো, টিসিবির পণ্য বিক্রি বাড়ানো, সরবররাহ নিশ্চিতে সহযোগিতা ও টাস্কফোর্স গঠনসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই মূল্য নিয়ন্ত্রণে আসছে না। উল্টো নিত্যপণ্যের বাজারে দিন দিন বাড়ছে ভোক্তার অস্বস্তি, নিম্নআয়ের মানুষের জীবনযাপন রীতিমতো দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে; মধ্যবিত্তরাও দিশাহারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও সেগুলো পুরনো মডেলের। এগুলো অতীতেও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কার্যকর ফল মেলেনি। বাজার ব্যবস্থাপনায় বড় গলদগুলো এখনও রয়ে গেছে। এগুলো না শুধরে পুরনো কায়দায় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তাতে হিতে বিপরীত হচ্ছে। ক্রয়-বিক্রয়ে অনিয়ম, কারসাজি, সিন্ডিকেট, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও চাঁদাবাজি কিছুই বন্ধ হয়নি। দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বাজারেও পরিবর্তনের প্রত্যাশা ছিল ভোক্তাদের। কিন্তু তা হয়নি। মূল্যবৃদ্ধির পুরনো বৃত্তেই বন্দি হয়ে আছে বাজার।

বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার নানা আশাবাদ ব্যক্ত করলেও বাজার নিয়ন্ত্রণে আমরা নতুন তেমন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আগের মডেলেই তো চলছে। মন্ত্রণালয়গুলো দাম বেঁধে দিচ্ছে আর বাজারে ‘ডান্ডাবাজি’ চলছে। অতীতেও এগুলো হয়েছে কিন্তু সুফল মেলেনি। উল্টো পণ্যের বাজার নষ্ট হয়েছে। বাজার ব্যবস্থাপনায় আমাদের বড় বড় গলদ এখনও রয়ে গেছে। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে প্রথমত নীতিনির্ধারকদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। পুলিশি কায়দায় যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চলছে, সেভাবে হবে না। হুকুম দিলাম আর সেই দামে বিক্রি হবে এমনটা নয়। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। যেমন ডিমের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমাদের উৎপাদন থেকে শুরু করে সরবরাহ, ভোক্তা প্রতিটি পর্যায়ে নজরদারি থাকতে হবে। বাজারে প্রতিযোগিতা তৈরি করতে হবে। এ জন্য নতুনদের প্রবেশের পথ মসৃণ করতে হবে। অথচ আমরা দেখতে পাই নতুন ব্যবসায়ীরা মোটেও সুবিধা করতে পারছেন না। সামান্য ট্রেড লাইসেন্স নিতে গিয়েই নানান ঝামেলা পোহাতে হয়। দ্বিতীয়ত মুক্তবাজার বলা হলেও বাস্তবে আমাদের পণ্যের বাজার মুক্ত নয়, এটা নানাভাবে প্রভাবিত। এখানে বড় খেলোয়াড়রাই খেলছে। আমদানিনির্ভর পণ্যও কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানের কব্জায়। পণ্যের দাম বাড়লে নতুন ব্যবসায়ীদের প্রবেশ ও প্রতিযোগিতা বাড়ার কথা। কিন্তু তা বাড়ছে না। অপরদিকে প্রতিযোগিতা বাড়াতে আমদানির দরজা খুলে দেওয়া হচ্ছে, সেক্ষেত্রেও বড় খেলোয়াড়রাই আমদানি করছে। আবার আমদানিতে শুল্কসহ যেসব সুবিধা দেওয়া হয়, সেটাও তারাই শুধু ভোগ করেন; ভোক্তা পর্যন্ত সেই সুবিধা পৌঁছায় না। এ ছাড়া মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যও রয়েছে। তৃতীয়ত বাজারে শৃঙ্খলার ব্যপক ঘাটতি রয়েছে। পণ্য পরিবহন থেকে শুরু করে ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি হচ্ছে, যা ব্যবসায়ীদের হিডেন কস্ট বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে তারা পণ্যের মূল্যও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর চাঁদাবাজি বন্ধ হয়েছিল। সেটার সুফলও পেয়েছেন ভোক্তারা। কিন্তু সেটা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিসুদের হার বাড়ালেও দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। গত এপ্রিল থেকে টানা ছয় মাস ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি। বাজারে একের পর এক পণ্যের দাম কেবল বেড়েই চলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু নীতিসুদ হার বাড়িয়ে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এর প্রভাব পড়তে সময়ের প্রয়োজন। বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর বিকল্প নেই।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকার ম্যাক্রো পর্যায়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নিলেও বাজারে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আগের কায়দায় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এতে কতটা সুফল মিলবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলে মনে করছেন বিশিষ্ট বাজার বিশ্লেষক গোলাম রহমান। তিনি বলেন, একদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এখনও উন্নতি হয়নি। এতে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। অপরদিকে পূর্বের সরকার এত পরিমাণে টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছেড়েছে, সেটার মাশুল এখনও দিতে হচ্ছে। বাজার থেকে অতিরিক্ত এ টাকা তুলে নিতে অনেক সময় লাগবে। বাজার ব্যবস্থাপনায় পুরনো ত্রুটিগুলো রয়ে গেছে উল্লেখ করে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাবেক এই সভাপতি বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে মূল্য বেঁধে বা অভিযান চালিয়ে নিয়ন্ত্রণ হবে না। পণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি দরকার। একটি পণ্যের উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছতে হাত বদলের সংখ্যা কমাতে হবে। আরেকটি বড় সমস্যা চাঁদাবাজি। তিনি বলেন, শুধু চাঁদাবাজি বন্ধ হলেই পণ্যের মূল্য ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমে যাবে।

রাজধানীর বাজার চিত্র বলছে, ৬২ থেকে ৬৪ টাকায় বিক্রি হওয়া সরু চাল এখন ৭২ থেকে ৭৪ টাকা হয়েছে। মধ্যবিত্তের মাঝারি আটাশ চালের কেজি ৬০ টাকা এবং নিম্নবিত্তদের মোটা চাল ৫৫ টাকা ছাড়িয়েছে। কৃষকের কাছ থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে কেনা আলু মজুদ করে এখন খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা পর্যন্ত। পেঁয়াজের কেজি এখনও শতকের ওপর রয়েছে। বেশি দামে কিনতে হচ্ছে আদা-রসুনও। নতুন করে সবজির দর বেড়েছে। কমের মধ্যে মিলছে শুধু পেঁপে, কেজি ৫০ টাকা।

কৃষকের কাছ থেকে প্রতিকেজি আলু ১৫ টাকা দরে কিনে মজুদ করা হলেও তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা পর্যন্ত। মুরগি ও ডিমের বাজারে অস্থিরতা তুঙ্গে। বাজারে পণ্য দুটির সরবরাহ এক রকম বন্ধ করে দিয়েছেন সরবরাহকারীরা। উৎপাদক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে ডিম ও মুরগির দর নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। অথচ বাজারে এর প্রভাব নেই। শুধু তাই নয়, অভিযানের ভয়ে বিক্রি বন্ধ রেখেছেন অনেক ব্যবসায়ী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মালিবাগ বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, তেজগাঁও আড়তে ট্রাক আসছে না। সোমবার থেকে চাহিদামাফিক ডিম পাচ্ছি না। পেলেও সঙ্গে পাকা রসিদ পাচ্ছি না। অথচ রসিদ না থাকলে অভিযানে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। বাধ্য হয়ে আজ (গতকাল মঙ্গলবার) দোকান বন্ধ রেখেছি। এভাবে ব্যবসা বন্ধ থাকলে দৈনিক অনেক টাকার ক্ষতি গুনতে হবে।

এদিকে গতকাল থেকে রাজধানীতে খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) কার্যক্রমের আওতায় আলু, ডিম, পেঁয়াজ ও পটোল বিক্রি শুরু করেছে সরকার। ঢাকার অন্তত ২০টি স্থানে দুই সপ্তাহ বিভিন্ন শাকসবজি বিক্রি করা হবে। যদি পাইলট বা পরীক্ষামূলক এ প্রকল্প সফল হয়, তা হলে সবজি বিক্রির পয়েন্ট বা স্থান ও সময়ের ব্যাপ্তি বাড়ানো হবে।

গোলাম রহমান বলেন, টিসিবি, ওএমএস কর্মসূচির মতো উদ্যোগগুলো ইতিবাচক। তবে এগুলো ‘কসমেটিক’ উদ্যোগ। এতে নির্দিষ্ট সংখ্যক উপকারভোগী উপকৃত হবেন মাত্র। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব নেই। বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর বিকল্প নেই। প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া সামাজিক ব্যবসার যে মডেলের কথা বলা হচ্ছে, সেটা যদি বাস্তবায়ন করা যায়- তা হলে দীর্ঘমেয়াদে এর ইতিবাচক প্রভাব পাওয়া যাবে।