উন্নয়ন দেখাতে ফাঁপিয়ে তোলা হয় রপ্তানির হিসাব
লক্ষ্য ছিল ভোটার তুষ্টি ।। বড় ক্ষতি ব্যবসায়ীদের
বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের উন্নয়ন বোঝাতে গিয়ে রপ্তানির হিসাব ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। এ ছাড়া ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের জন্য ব্যবসায়ীদের ধোঁয়াশার মধ্যে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, নির্বাচন সামনে থাকায় জনতুষ্টির জন্য রপ্তানির পরিমাণ বেশি দেখানো হয়। ফলে উৎপাদনকারীরা ব্যাপক ক্ষতির মধ্যে পড়েন। এমনকি রপ্তানির পরিমাণ বেশি দেখানোয় উৎপাদনকারীদের সুযোগ-সুবিধা পাওয়া থেকে বঞ্চিত করেছে সরকার। পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ধরনের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় ব্যবসায়ীদের ওপর। রপ্তানির প্রবৃদ্ধি বেশি দেখানোয় কারণে শ্রমিক পক্ষের দাবিও শক্তিশালী হয়। এতে নতুন উদ্যোক্তারাও বিপদে পড়েন। ভুল তথ্য দেওয়ায়
বিশ্ববাজারে পণ্যের চাহিদা কম থাকলেও উৎপাদন বাড়িয়ে শঙ্কায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। এতে সার্বিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রভাব পড়েছে রিজার্ভের ওপর। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা এমনটাই মনে করছেন।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলেছেন, রপ্তানির পরিমাণ বেশি দেখিয়ে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার একদিকে বিশ্ব কর্তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো অবস্থায় রয়েছে। অন্যদিকে আবার ক্ষমতায় আসতে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় জনগণকে তুষ্ট করার চেষ্টা হয়েছে। এ ছাড়া রপ্তানির মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়েছে বলেও মনে করেন তারা। পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
আওয়ামী লীগ সরকার গেল দুই বছর ধরে প্রকৃত আয়ের চেয়ে রপ্তানি আয় বেশি দেখায়। রপ্তানির হিসাব রাখে সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। বিগত সরকারের বিরুদ্ধে এমনও অভিযোগ রয়েছে, ইপিবি প্রকৃত তথ্য দিলেও সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বাড়িয়ে দেওয়া হতো। যদিও ইপিবির দেওয়া তথ্য বরাবরই মানতে না রাজ ছিলেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। এমনকি ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ইপিবির হিসেব ঠিক নাই। এই বক্তব্যের কারণে তখন এক ব্যবসায়ীকে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।
এদিকে হিসাবে এই গরমিলের তথ্য আসলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া শর্তের পর দেখা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যেও ব্যাপক গরমিল। তবে এই গরমিলের দায় এড়িয়ে গেছে সংশ্লিষ্ট সরকারি তিনটি সংস্থাই। বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) দায় চাপাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাঁধে। অন্যদিকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা দিয়ে দায় এড়িয়েছে এনবিআরও। তবে এই গরমিলের আড়ালে অর্থপাচার এবং রপ্তানি না করেই রপ্তানি প্রণোদনার টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এতে টাকার অবমূল্যায়নের আশঙ্কা করছেন তারা।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বিশ্লেষকরা মনে করেন, রপ্তানির তথ্যে এই ভুল হিসাব দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বহু হিসাব-নিকাশ পাল্টে দেবে। একই সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রকাশ করা তথ্য নিয়ে বৈশ্বিক অঙ্গনে নতুন করে প্রশ্ন উঠবে বলে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কাস্টম হাউসের তথ্যের ভিত্তিতে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে ইপিবি। পদ্ধতিগত কারণে কাস্টম হাউসের তথ্যে একই রপ্তানি একাধিকবার দেখানোর (ডাবল বা ট্রিপল কাউন্টিং) ঘটনা ঘটেছে। আবার পণ্যের গুণগত মান বা অন্য কারণে কাস্টম হাউসের শিপমেন্ট বাতিলের পর আবারও রপ্তানির জন্য দুইবার গণনা করা হয়েছে। এসব কারণে ইপিবির তথ্যে রপ্তানি বেশি দেখাচ্ছিল।
রপ্তানির হিসাব মিলছে না : ইপিবির হিসাবে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৪ হাজার ৫৬৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ওই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ৩ হাজার ৬১৩ কোটি ডলারের। তাদের হিসাবে ৯৫৪ কোটি ডলারের রপ্তানি কম হয়েছে।
আর বিদায়ী অর্থবছর ২০২৩-২৪ সালের প্রথম ১০ মাসে ইপিবির হিসাবে ৪ হাজার ৭৪৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ডলারের। তাদের হিসাবে রপ্তানি ১ হাজার ৩৮০ কোটি ডলার কম।
বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস এবং এর আগের অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস মিলিয়ে মোট ২০ মাসে ৯ হাজার ৩১৪ কোটি ডলারের রপ্তানির তথ্য দিয়েছিল ইপিবি। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ওই ২০ মাসে রপ্তানি হয়েছে ৬ হাজার ৯৮০ কোটি ডলার। সে হিসাবে ২ হাজার ৩৩৪ কোটি ডলারের কম রপ্তানি হয়েছে, যা ইপিবির হিসাবের চেয়ে ২৫ শতাংশ কম।
এদিকে তথ্যের গোঁজামিলের কারণে সাধারণ মানুষের ওপর নেমে এসেছে নানা রকমের ভোগান্তি, যা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে সৃষ্টি হয়েছে অস্থিরতা ও আস্থাহীনতা। শত কৌশলেও ঠেকানো যায়নি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। এমকি রপ্তানিকারকরা ব্যাপক চাপে পড়ে। কাগজে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি দেখা গেলেও বাস্তবে তা হয়নি। রপ্তানির প্রবৃদ্ধির কারণে নানা চাপে পড়ে তারা। বিশেষ করে শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে মাঠে নামেন। শ্রমিকরা বলেন, মালিকরা বেশি আয় করছে, অথচ শ্রমিকদের ঠকাচ্ছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আমাদের সময়কে বলেন, হিসাবের গরমিলে রপ্তানির অর্থ ফেরত আসেনি। এখানে অসৎ ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিয়েছে। এ জন্য ব্যাক টু ব্যাক এলসির তথ্য বের করা দরকার। তিনি বলেন, রপ্তানির তথ্যে খুব বেশি গরমিল হয়নি। যতটুকু হয়েছে এর পেছনে বড় কারণ হচ্ছে পণ্য রপ্তানির পর অনেক সময় স্টকলট হয়ে যায়। ওই হিসাবটা বিবিএসের কাছে থাকে না। বিবিএস শুধুমাত্র রপ্তানির হিসাব রাখে। রপ্তানির আড়ালে বিদেশে যে অর্থ পাচার হয়েছে, তা ফেরত আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আমরা আগে থেকেই বলেছিলাম, ইপিবির দেওয়া তথ্যে সমস্যা আছে। ইপিবি রপ্তানির হিসাব বেশি দেখাচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, দেশের অর্থনীতি চাপে পড়েছে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, বিগত সময়ে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি বেশি দেখানোর কারনে ব্যবসায়ীরা নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অন্যদিকে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি বেশি দেখিয়ে ব্যাংক ঋণের সুদ হার বাড়িয়েছে। রপ্তানি ভালো দেখে নতুন বিনিয়োগকারিরাও বিপদে পড়েন। কারণ, হিসাবের সঙ্গে বাস্তবে মিল না থাকায় ব্যবসার হিসাব মিলাতে পারেননি তারা।