প্রতিমা বিসর্জনে শেষ হলো দুর্গোৎসব
ভক্তদের আবার এক বছরের অপেক্ষায় রেখে মর্ত্যলোক ছেড়ে কৈলাসে পাড়ি দিলেন দেবীদুর্গা। অশ্রুসজল চোখে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে গতকাল রবিবার দুর্গা মাকে বিদায় জানিয়েছেন ভক্তরা। এদিন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে ঢাক-কাঁসরের বাদ্য-বাজনা, রাত্রি উজ্জ্বল করা আরতি ও পূজারি-ভক্তদের পূজা-অর্চনা কেবলই ছিল মা দুর্গার বিদায়ের আয়োজন। এর মাধ্যমে শেষ হলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব। এবারের দুর্গোৎসবে তিথির কারণে নবমীর দিনই বিহিত পূজা এবং দর্পণ বিসর্জন হয়। তবে গতকাল দশমীর দিনে সিঁদুর খেলা, দুর্গাকে মিষ্টি মুখ করানো এবং প্রতিমা
বিসর্জনের শোভাযাত্রার আয়োজন রাখা হয়। ঢাকেশ্বরী, রমনা কালী মন্দিরসহ ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন মন্দির ও মণ্ডপে বিজয়া দশমীতে গতকাল সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন সনাতন ধর্মের অনুসারীরা।
গতকাল বেলা ১১টায় রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে শুরু হয় বিবাহিত নারীদের সিঁদুর খেলা। বিবাহিত নারীরা সিঁদুর, পান ও মিষ্টি নিয়ে দুর্গা মাকে সিঁদুর ছোঁয়ানোর পর একে-অপরকে সিঁদুর মাখিয়ে দেন। তারা এই সিঁদুর মাখিয়ে দুর্গা মাকে বিদায় জানান। দেবীকে নিয়ে যাওয়ার আগে সিঁথিতে সিঁদুর মাখানোর পর আঙুলে লেগে থাকা বাকি সিঁদুরটুকু তারা একে-অপরের মুখে মাখেন। এ সময় তারা মিষ্টিমুখ করেন, নাচে-গানে আনন্দময়ীর বন্দনা করেন এবং দুর্গার নামে জয়োধ্বনি তোলেন।
ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের উপদেষ্টা পুরোহিত প্রণব চক্রবর্তী বলেন, সধবা নারীরা সিঁদুর দিয়ে সংসারের জন্য কল্যাণ প্রার্থনা করেন। সিঁদুর খেলার মাধ্যমে দুর্গা মায়ের বিদায় মুহূর্তে আমরা একে-অপরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় এবং সবার কল্যাণ কামনা করি। পারস্পরিক ঐক্য ও সৌহার্দের বার্তা দেওয়া হয় এর মাধ্যমে।
ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সিঁদুর খেলতে আসা অনন্যা সাহা বলেন, স্বামীর মঙ্গল কামনায় মায়ের কাছে প্রার্থনা করেছি। তার পায়ে সিঁদুর ছুঁয়ে দিয়ে তার কিছুটা নিজের সিঁথিতে লাগিয়েছি সংসারের মঙ্গল কামনায়। মায়ের চরণে সিঁদুর দিতে আসা সুমিতা বলেন, মনের মতো স্বামী এবং সুখের সংসারের কামনায় আমার মতো অবিবাহিত কুমারী মেয়েরাও সিঁদুর খেলতে আসে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
এ ছাড়া দশমীর দিন রক্তদান কর্মসূচির আয়োজন করে পূজা উদযাপন পরিষদ। বিকাল ৩টায় পর ঢাকার পলাশীর মোড় থেকে প্রতিমা বিসর্জনের শোভাযাত্রা বের করে পূজা উদযাপন পরিষদ। দুপুর থেকেই রাজধানীর ওয়াইজঘাটে শুরু হয় প্রতিমা বিসর্জন। ঢাকের তালে নেচে-গেয়ে প্রতিমা নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে দেবী প্রতিমাকে বিসর্জন দিতে এই ঘাটে জড়ো হন ভক্তরা। মোহাম্মদপুরের বসিলা অংশেও প্রতিমা বিসর্জন দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়। কেন্দ্রীয় পূজা উদযাপন কমিটির সদস্য রজত কুমার বলেন, দুপুর ১২টা থেকে শুরু হয় প্রতিমা বিসর্জনের কার্যক্রম। কেন্দ্রীয় বিসর্জনের শোভাযাত্রা ঘাটে আসে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পর। এখানে রাত ১টা পর্যন্ত চলবে প্রতিমা বিসর্জন।
এবার সারাদেশে ৩১ হাজার ৪৬১টি মন্দির ও ম-পে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর এলাকায় পূজা অনুষ্ঠিত হয় ২৫২টি ম-পে। বিসর্জন অনুষ্ঠানকে নির্বিঘ্নে করতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) স্বাভাবিক নিরাপত্তার পাশাপাশি বাড়তি ট্রাফিক ও পুলিশ সদস্য মোতায়েন রেখেছে। ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, পলাশী মোড় ও বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায় তিনটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করা হয়। এ ছাড়া পলাশীর মোড়, রায় সাহেব বাজার ও ওয়াইজঘাটে স্থাপন করা হয় আরও তিনটি ওয়াচ টাওয়ার। পাশাপাশি ডগ স্কোয়াড, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, ক্রাইম সিন টিম ও সোয়াট দল সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা হয়। এ ছাড়া ওয়াইজঘাটে নৌ-পুলিশ, সেনাবাহিনী সদস্যরা নিরাপত্তার কাজ করেন। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ড্রোন মোতায়েন করা হয়। নদীতে সব জাহাজ, বাল্কহেড ও ট্রলার চলাচল বন্ধ রাখা হয়। বিসর্জনের প্রতিটি নৌকায় রাখা হয় একজন করে ডুবুরি।
কক্সবাজার থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, হাজার হাজার ভক্ত-পূজারি আর পর্যটকের উপস্থিতিতে দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিমা বিসর্জনের অনুষ্ঠান হয়েছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই এদিন ২৪৫টি প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় এ সৈকতে। গতকাল সরকারি ছুটি থাকায় প্রতিমা বিসর্জনের অনুষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক দেশি-বিদেশি পর্যটকের উপস্থিতিও ছিল।
সমুদ্র সৈকতের লাবণী পয়েন্টে কক্সবাজার জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে দুর্গাপূজার সমাপনী ও প্রতিমা বিসর্জন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিকাল ৩টার পর থেকে সমুদ্র সৈকতের লাবণী পয়েন্টে একে একে আসতে থাকে প্রতিমাগুলো। প্রতিমা বিসর্জন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন।
কক্সবাজার জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক দীপক শর্মা দিপু জানান, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবণী পয়েন্টে ৪৯টি ম-পের ২৪৫টি প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। সুষ্ঠুভাবে বিসর্জন সম্পন্ন হওয়ায় তিনি সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
চট্টগ্রাম ব্যুরো থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ব্যবস্থাপনায় অসংখ্য ভক্তের উপস্থিতিতে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতেও ঢাক-ঢোল বাজিয়ে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। গতকাল রবিবার বিকালে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত ছাড়াও নগরীর পাথরঘাটা গঙ্গাবাড়ি এলাকায় কর্ণফুলী নদীতে, কালুরঘাট এলাকায়, কাট্টলী রানী রাসমনি ঘাটেও প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। এ ছাড়া আনোয়ারার পারকি সমুদ্র সৈকতসহ চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন উপজেলায় স্থানীয়ভাবে নদী বা পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয় প্রতিমা।
চসিকের প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে শান্তিময় সম্প্রীতির জনপদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অর্পন কান্তি ব্যানার্জি।
চট্টগ্রামে এ বছর শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে ২ হাজার ৪৫৮টি ম-পে। এর মধ্যে মহানগরে ২৯৩টি ও জেলার ১৫টি উপজেলায় পূজাম-প রয়েছে ২ হাজার ১৬৫টি।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন