একের পর এক জ্বালানি ট্যাংকারে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড /

দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা

মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, চট্টগ্রাম
১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা

দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বিদেশি একটি মাদার ট্যাংকারসহ (এলপিজি ক্যারিয়ার) চারটি জাহাজে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন চারজন। সর্বশেষ গত শনিবার দিনগত রাতে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ‘বিএলপিজি সোফিয়া’ এবং তানজানিয়ার পতাকাবাহী ‘ক্যাপ্টেন নিকোলাস’ জাহাজে আগুন লেগে যায়। একের পর এক এমন দুর্ঘটনায় দেশের জ¦ালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জ¦ালানি বহনকারী এসব ট্যাংকারে ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডে প্রশ্ন জেগেছেÑ এগুলো কি নিছক দুর্ঘটনা? নাকি পরিকল্পিত নাশকতা? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতীতে জ¦ালানি খাতে এমন ধারাবাহিক দুর্ঘটনার নজির নেই। তাই নাশকতার শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মাকসুদ আলম বলেন, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের দুটি অয়েল ট্যাংকার এবং সর্বশেষ দুটি ট্যাংকারে আগুনের ঘটনা ভিন্ন প্রকৃতির। জ¦ালানি বহনকারী ট্যাংকারে ধারাবাহিক আগুনের ঘটনার প্রকৃত কারণ তদন্তের আগে বলা সম্ভব নয়।

জানা গেছে, গত শনিবার রাত পৌনে ১টার দিকে কক্সবাজারে বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়ায় উপকূলের পশ্চিমে বহির্নোঙরে বিএলপিজি সোফিয়া নামের লাইটারেজ জাহাজে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সোয়া ১১ ঘণ্টা চেষ্টার পর গতকাল রবিবার দুপুরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। জাহাজে থাকা ৩১ ক্রুকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। আগুন নিয়ন্ত্রণ ও ক্রুদের উদ্ধারে কোস্টগার্ডের দুটি, নৌবাহিনীর পাঁচটি অত্যাধুনিক জাহাজ, চট্টগ্রাম বন্দরের দুটি টাগবোট ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একটি টাগবোট কাজ করেছে। আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে কিছু নিশ্চিত করতে পারেনি বন্দর, কোস্টগার্ড ও অন্যান্য সংস্থা।

কোস্টগার্ড পূর্ব জোনের গণমাধ্যম কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার খন্দকার মুনিফ তকি জানান, জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে যাচ্ছিল। তবে কোন দেশ থেকে আসছিল এবং কী পরিমাণ এলপিজি ছিল, তা জানা যায়নি। এটি নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা, তা জানতে কোস্টগার্ডসহ সংশ্লিষ্টরা খোঁজ নিচ্ছেন বলে জানান তিনি।

সূত্র জানায়, তানজানিয়ার পতাকাবাহী এমটি ক্যাপ্টেন নিকোলাস দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের এলপিজি নিয়ে গত ৭ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর কুতুবদিয়ায় পৌঁছে। বসুন্ধরার মালিকানাধীন এমটি মারিয়া, সোফিয়া ও চাতকি লাইটার ট্যাংকার সেখান থেকে এলপিজি খালাসের দায়িত্বে ছিল। মারিয়া খালাস নিয়ে চলে যায়। শনিবার রাতে সোফিয়া জাহাজে এলপিজি খালাস শেষ হয়, কিন্তু মাদার ভেসেল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। এরই মধ্যে বিস্ফোরণে আগুন লেগে যায়। একই সঙ্গে ক্যাপ্টেন নিকোলাসেও আগুন লাগে। তবে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিকোলাসের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন জাহাজের ক্রুরা। কিন্তু সোফিয়া জাহাজে আগুন দ্রুত বাড়তে থাকে।

সোফিয়ার পরই এলপিজি খালাসের জন্য অপেক্ষায় ছিল এমটি চাতকি। ফলে মাদার ভেসেলের কাছাকাছি ছিল জাহাজটি। আগুনের

ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন এবং উদ্ধারে সরাসরি অংশ নিয়েছেন জাহাজের নাবিকরা। ওই জাহাজের ক্যাপ্টেন ফরমান উল্লাহ আনসারি বলেন, সোফিয়ার পরই মাদার ভেসেলের কাছে আমাদের জাহাজের ভেড়ার কথা, তাই কাছাকাছিই ছিলাম। এ সময় দুর্ঘটনার খবর জানতে পারি। এরই মধ্যে একটি আওয়াজ আসে এবং আগুন দেখতে পাই। দ্রুত সময়ের মধ্যে সোফিয়া জাহাজের প্রথম ও দ্বিতীয় ট্যাংকার হয়ে তৃতীয় ট্যাংকারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি আমি পোর্ট কন্ট্রোল ও কোস্টগার্ডকে জানাই। পাশাপাশি সহযোগিতা চেয়ে জরুরি সিগন্যাল চালু করি। কিছুক্ষণের মধ্যেই বসুন্ধরার মালিকানাধীন টাগবোট তুফান এক্সপ্রেস কাছাকাছি চলে আসে। নিকোলাস জাহাজের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছে এবং সবাই নিরাপদ আছেন বলে জানান। আগুন লেগে যাওয়ায় সোফিয়া জাহাজের নাবিকরা সাগরে ঝাঁপ দেন। এরপর আমরা তাদের উদ্ধার করি।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর বেলা পৌনে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম বন্দরের ডলফিন জেটিতে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের মালিকানাধীন ‘বাংলার জ্যোতি’ অয়েল ট্যাংকারে বিস্ফোরণের পর আগুন লাগে। ওই ঘটনায় তিনজনের মৃত্যু হয়। এরপর ৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ‘বাংলার সৌরভ’ নামের আরেকটি তেলবাহী জাহাজে আগুন লাগে। ওই জাহাজটিও বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের মালিকানাধীন। ওই দিনের ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয়। ঘটনার পর বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুল মালেক সংবাদ সম্মেলনে ‘নাশকতার’ আশঙ্কার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তার মতে, এ ঘটনা জাতীয় জ¦ালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার অপচেষ্টা। শনিবার দিনগত রাতে সোফিয়ায় অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার অবস্থান থেকে আমি সরাসরি বলতে পারি না। তবে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তদন্ত প্রতিবেদনের পর সুনির্দিষ্ট কারণ বলা যাবে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সচিব শাহিনা সুলতানা বলেন, এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি বলেই জানি। তবে এই মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। নাশকতার বিষয়ে তদন্তের পরই বলা যাবে। তদন্তের আগে মন্তব্য করতে রাজি হননি বিস্ফোরণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের পরিদর্শক মো. তোফাজ্জল হোসেনও। তবে তিনিও জাতীয় জ¦ালানি নিরাপত্তায় বিঘ্নের আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কুতুবদিয়া অ্যাংকারেজ এলাকায় অবস্থানরত এমটি ক্যাপ্টেন নিকোলাস জাহাজ ও সোফিয়া জাহাজে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (হার্বার অ্যান্ড মেরিন) কমডোর এম ফজলার রহমানকে। কমিটিতে নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, ডিজিএফআই, এনএসআই, নৌপরিবহন অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সংস্থার প্রতিনিধিও আছেন। কমিটিকে আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মাকসুদ আলম জানান, আগের দুটি ও গতকালের আগুনের ঘটনায় প্রকৃতিগত পার্থক্য আছে। গত শনিবার রাতে কার্গো অপারেশনের সময় দুর্ঘটনা ঘটেছে, ফলে সেখানে সেইফটি-সিকিউরিটির ঘাটতি ছিল কি না, সেটা তদন্ত কমিটি দেখবে। নাশকতার বিষয়ে তিনি বলেন, ফরেনসিক রিপোর্ট ছাড়া এটা বলা মুশকিল।

এদিকে কারও ওপর দোষ না চাপিয়ে তদারক সংস্থাগুলো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেছে কিনা এবং তাদের কোনো অবহেলা ছিল কিনা, সা খতিয়ে দেখার প্রতি জোর দিয়েছেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ।