গ্রহীতাদের গলার কাঁটা রাজউকের বিশেষ প্লট
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছ থেকে বিশেষ বিবেচনায় বরাদ্দপ্রাপ্ত প্লট নিয়ে বর্তমানে ভীষণ বিপাকে আছেন প্লটগ্রহীতারা। কারণ যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তখন সে সরকারের সুবিধার্থে তাদের ইচ্ছানুযায়ী বিধিমালা পরিবর্তন করে প্লট বরাদ্দ দিয়েছে। বিশেষ করে গত ১৫ বছর শেখ হাসিনার শাসনামলে এমন কাণ্ডের নজির সর্বাধিক। গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা দেন, বিধিবহির্ভূতভাবে যারা সরকারি প্লট নিয়েছেন, সেগুলো বাতিল করা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় রাজউকে চলছে যাচাই-বাছাই এবং প্লটগ্রহীতাদের তালিকা তৈরির কাজ। এর পাশাপাশি বিশেষ বিবেচনায় দেওয়া সব প্লটের ক্রয়-বিক্রয়, উন্নয়ন, অবকাঠামো নির্মাণসহ সব ধরনের কাজ বন্ধ রেখেছে রাজউক। এর ফলে গ্রহীতারা প্লটের কোনো কাজ করতে পারছেন না। শুধু তাই নয়, নিতান্ত প্রয়োজনে যারা প্লট বিক্রয় করতে চাইছেন, তারাও পড়েছেন বিপাকে। উপরন্তু, এর আগে যারা প্লট বিক্রি করে দিয়েছিলেন, যেসব প্লটের মালিকানা তিন-চার হাত পর্যন্ত ঘুরে গেছে, তারাও এখন আইনি জটিলতায় পড়ছেন। সব মিলিয়ে প্লটগ্রহীতাদের ত্রিশঙ্কু দশা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্লটগ্রহীতাদের মধ্যে কেউ কেউ আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার কথাও ভাবছেন।
জানা গেছে, ক্ষমতার শীর্ষপর্যায়ে থাকা ব্যক্তিরা তাদের মর্জিমাফিক প্লট নেওয়া এবং পছন্দের লোকজনদের বিশেষ বিবেচনায় প্লট বরাদ্দ দেওয়ার পর বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। সরকারের বিধি অনুসরণ করে রাজউক নির্ধারিত প্লটের মূল্য পরিশোধ করে অনেকে বরাদ্দকৃত প্লট উচ্চমূল্যে বিক্রিও করে দিয়েছেন। এক প্লট একাধিক হাত বদলও হয়েছে। ফলে বর্তমান সরকার এসব বরাদ্দ বাতিল করলে মূল মালিকের বরাদ্দ বাতিল হবে। কিন্তু ইতোমধ্যেই যেসব প্লটের মালিকানা হাতবদল হয়ে গেছে, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় পড়ে গেছেন সেই সব প্লটের ক্রেতা-বিক্রেতারা। তাদের টাকা পরিশোধ কোন প্রক্রিয়ায় ফেরত দেওয়া হবে, এ নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। খোদ রাজউক কর্মকর্তারাই এটি ভীষণ জটিল প্রক্রিয়া বলে মনে করছেন।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, রাজউকের উত্তরা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়; পূর্বাচল, ঝিলমিল এসব প্রকল্পে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ২ হাজারের মতো প্লট বিশেষ বিবেচনায় দেওয়া হয়েছে। সরকারপ্রধান বা মন্ত্রী, এমপিদের সুপারিশের ভিত্তিতে রাজউক এসব বরাদ্দ দিয়েছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বেরিয়ে আসতে থাকে বিশেষ বিবেচনায় পাওয়া এসব প্লটের একের পর এক তথ্য। পূর্বাচলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা তাদের সন্তানাদির নামেসহ ৬টি প্লট নিয়েছেন, যেগুলোর প্রতিটি ১০ কাঠা করে। এ তালিকায় আরও রয়েছেন স্পিকার, মন্ত্রী, এমপিসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ।
কোটায় প্লট পাওয়া এক গণমাধ্যমকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের সময়কে জানান, আমি ২০০৭ সালে আবেদন করি। গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে কোটায় ২০১০ সালে প্লট পাই। এরপর রেজিস্ট্র্রেশন কার্যক্রম শেষ করেছি। সরকারি সব নিয়মনীতি অনুসরণ করেই প্লট নিয়েছি। ২০২৮ সাল পর্যন্ত জমির খাজনাও দিয়েছি। এখানে কোনো নিয়মের ব্যত্যয় আমি ঘটাইনি। তা হলে আমার প্লটে কেন কাজ করতে দেবে না? আমি একটা ডেভেলপারকে দিয়েছি কাজ করার জন্য। তারা বলছে, রাজউক সব কার্যক্রম স্থগিত রেখেছে। পূর্বাচলে ১৩/ক ধারায় পাওয়া প্লটের কার্যক্রম স্থগিত রেখেছে। এটা কেন করেছে? আমাদের তো কোনো অন্যয় নেই।
ঠিক একই কথা বলেছেন একজন শিক্ষক। তিনিও পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, আমরা তো রেজিস্ট্র্রেশনও শেষ করেছি। অনেক কষ্টের টাকা দিয়ে একটা প্লট নিয়েছিলাম। এই পূর্বাচল কত বছরে প্রস্তুত হচ্ছে? আমরা যখন টাকা দিয়েছি তখন এক লাখ টাকাও অনেক টাকা ছিল। আমাদের সাথে অনেকে প্লট বিক্রি করে দিয়ে গেছে। তারা হয়তো বেঁচে গেছে কিন্তু আমাদের কী হবে?
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বিশেষ বিবেচনায় রাজউকের প্লটগুলোর বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হামিদুর রহমান খান আমাদের সময়কে বলেন, বিশেষ বিবেচনার প্লট তালিকা হয়েছে। আরও একটি তালিকা হচ্ছে সরকারি সিদ্ধান্তে। তালিকা পেলে এগুলোর কোনটা বিধিবহির্ভূত হয়েছে সেটা যাচাই-বাছাই করার জন্য কমিটি হবে। সেই কমিটি সিদ্ধান্ত দেবে। এরপর সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটাই হবে।
বিশেষ বিবেচনায় পাওয়া প্লটের বিষয়ে রাজউকের পরিকল্পনা জানতে চাইলে সংস্থাটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. ছিদ্দিকুর রহমান সরকার আমাদের সময়কে বলেন, সরকারের তরফে তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে। আমরা তালিকা করছি। তালিকা চূড়ান্ত হলে সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যমের কাছে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে। তবে এটা মনে রাখতে হবে, বিশেষ বিবেচনার প্লট রাজউক কখনো দেয়নি। এটা সরকারের নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত। মন্ত্রণালয় যেভাবে অনুশাসন দিয়েছে রাজউক সেভাবেই বাস্তবায়ন করেছে। কাজেই এখন বাতিল হলেও মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত আসতে হবে। মন্ত্রণালয় যেভাবে চাইবে সেভাবেই হবে।
বর্তমানে এসব প্লটের কার্যক্রম স্থগিত কি না জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, যেহেতু যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলমান, তাই আপাতত কেনা-বেচা, উন্নয়ন কাজ সবকিছু স্থগিত রাখা হয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর বিশেষ বিবেচনার প্লট নিয়ে কাজ হবে।
রাজউকের সম্পত্তি বিভাগের তথ্যমতে পূর্বাচল-ঝিলমিল ও উত্তরা প্রকল্পে ১৫ শতাধিক প্লট বিশেষ বিবেচনায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে পূর্বাচলেই বেশি। সেখানে ১২শ থেকে ১৩শ প্লট দেওয়া হয়েছে বিশেষ বিবেচনায়। ঝিলমিলেও এমন ২ শতাধিক প্লট রয়েছে। এ ছাড়া উত্তরাতেও কিছু প্লট বিশেষ বিবেচনায় দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, গত ১৫ বছরে কাকে, কীভাবে এবং মোট কতটি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেসব তথ্য প্রদানে।
রাজউকের সম্পত্তি শাখায় কাজ করার সাবেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের সময়কে বলেন, শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্লট দিয়েছে; বিষয়টা এমন না। আগেও দিয়েছে। এটা সরকারের সিদ্ধান্ত। সংসদে আইন পাস করে এটা করেছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থেকেছে তারা তাদের সুবিধামতো প্লট দিয়েছে। এটা সরকারের ইচ্ছায় হয়। এটা নতুন কোনো কিছু না।
সংরক্ষিত কোটায় যেভাবে প্লট দেওয়া হয়
দেশে সংরক্ষিত কোটায় সরকারি প্লট বা বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া ষাটের দশক থেকেই চলে আসছে। এ সুবিধার আওতায় মূলত সরকার সমর্থক লোকজনই গুরুত্ব পেয়ে থাকে। টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৫৩ অনুযায়ী এসব প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। আইনটির ১৩/এ ধারা অনুযায়ী সংসদ সদস্য, বিচারপতি, মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা এবং যারা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবদান রাখেন, তারা প্লট বরাদ্দ পান।
জানা যায়, শুরুর দিকে ধানমন্ডি এলাকায় প্লট বরাদ্দ দিত সরকার। পরে পর্যায়ক্রমে গুলশান, বনানী-বারিধারা, মিরপুরের সরকারি আবাসন প্রকল্প থেকে সংরক্ষিত কোটায় প্লট বরাদ্দ দেওয়া শুরু হয়। ১৯৯০ সালের পর থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একাধিকবার গঠিত সরকার সংরক্ষিত কোটায় প্লট ও বাড়ি বরাদ্দ অব্যাহত রাখে। সংসদ সদস্য, বিচারপতি, সচিব, কূটনীতিবিদ, শিল্পী-সাহিত্যিক, আইনজীবী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ নানা পেশাজীবীর পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীরাও এ সুবিধায় প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন