বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চুক্তি পর্যালোচনা চলছে
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, সাবেক সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান দায়িত্ব নেওয়ার পর কর্মপরিচালনার পাশাপাশি বিগত সময়ের বিতর্কিত চুক্তি ও কর্মকাণ্ড পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেন। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ গত দুই মাসে যেসব উল্লেখযোগ্য সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিতর্কিত বিশেষ আইন স্থগিতকরণ, এলওআই ইস্যুকৃত ৩১টি নবায়নযোগ্য প্রকল্প বাতিল, কিছু প্রকল্প পর্যালোচনা, আদানির সঙ্গে চুক্তি পর্যালোচনা, সামিটের সঙ্গে এলএনজি চুক্তি বাতিল, বিলাসী প্রকল্পগুলোর ধীরগতিতে বাস্তবায়ন।
প্রসঙ্গত, দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া বাতিল করে দিয়ে গণশুনানির মাধ্যমে মূল্য সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নেন ফাওজুল কবির খান। এ ছাড়া বিগত সরকারের তৈরি করা সবচেয়ে বিতর্কিত ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন-২০১০, পরে সংশোধিত-২০২১’
আইনটির কার্যক্রম রহিত করে দেন তিনি। এ আইনের অধীনে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এটি বিদ্যুৎ খাতের ‘ইনডেমনিটি আইন’ হিসেবে পরিচিত।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নতুন সরকারের উল্লেখযোগ্য কিছু সংস্কারের মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০, পরে সংশোধিত ২০২১-এর অধীনে পরিকল্পিত সব কার্যক্রম বাতিল। এখন থেকে টেন্ডারের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী আদেশে জ্বালানির দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়েছে। এখন থেকে গণশুনানির মাধ্যমে দাম সমন্বয় করা হবে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে হাসিনা সরকারের আমলে ভারতের বেসরকারি কোম্পানি আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তি করা হয়েছিল, যা নিয়ে সারাদেশে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়। বর্তমান সরকার সেই চুক্তি পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে, দাম নিয়ে উদ্বেগ এক পাশে রেখে আদানি পাওয়ারের কাছ থেকে বিদ্যু কেনার চুক্তি বহাল রাখতে পারে বাংলাদেশ। বিদ্যুৎ সরবরাহ করা নিয়ে দুশ্চিন্তা ও সম্ভাব্য আইনি জটিলতার মধ্যে এমন কথা জানিয়েছে এ বিষয়ে সরাসরি অবগত দুটি সূত্র।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার দেশের স্বার্থ যথাযথভাবে রক্ষা করে বিভিন্ন চুক্তি করেছে কি না, বিশেষ করে এসব চুক্তিতে স্বচ্ছতার অভাব আছে কি না তা নিরূপণে এক বিশেষ আইনের অধীনে একটি প্যানেল গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
২০১৭ সালে আদানির সঙ্গে ২৫ বছর মেয়াদি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি হয়। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ঝাড়খণ্ডে আদানির ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে মূলত বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। দুটি সূত্রের একটি বলছে, বাংলাদেশে বিদ্যুতের মোট চাহিদার প্রায় এক দশমাংশের জোগান আসছে প্রকল্পটি থেকে। তাই আদানির চুক্তি সরাসরি বাতিল করা কঠিন হবে।
সংস্কার প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন কোম্পানির বোর্ডের চেয়ারম্যান থেকে সেই মন্ত্রণালয়ের সচিবদের বাদ দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে যে, মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন কোম্পানির বোর্ডে খোদ মন্ত্রণালয়ের সচিবরা বোর্ড চেয়ারম্যান হওয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতিতে কোম্পানিগুলো ডুবে আছে। এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও খোদ সচিবই বোর্ড চেয়ারম্যান হওয়ায় এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
এ ছাড়া সবচেয়ে বড় যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেটা হলো- ১৪ বছর আগে করা ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান আইন)’-এর আওতায় করা সব চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করা হবে। এই আইনের অধীনে গত ১৪ বছরে ছোট-বড় মিলিয়ে কম-বেশি ৯১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি হয়েছে। আর জ্বালানি খাতে কম-বেশি ১৫টি চুক্তি হয়েছে। এসব চুক্তি পর্যালোচনায় পাঁচ সদস্যের জাতীয় কমিটি গঠন করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এ ছাড়া গত সপ্তাহে বেসরকারি কোম্পানি সামিট পাওয়ারের সঙ্গে সরকার এলএনজি টার্মিনালের চুক্তি বাতিল করেছে। যদিও সামিট বলছে, তারা বিষয়টি নিয়ে আদলতে যাবে।
এদিকে পর্যালোচনা কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীকে। কমিটির সদস্য বুয়েটের অধ্যাপক আবদুল হাসিব চৌধুরী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট আলী আশফাক, বিশ^ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এবং ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক মোশতাক খান।
তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০ সালে দুই বছরের জন্য ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন’ করে। ২০১২ সালে দুই বছর, ২০১৪ সালে চার বছর, ২০১৮ সালে তিন বছর এবং ২০২১ সালে পাঁচ বছরের জন্য আইনটির মেয়াদ বাড়ানো হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সরকারের এ সংক্রান্ত কমিটি ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে পর্যালোচনার কাজ শুরু করেছে। বিশেষভাবে আদানিসহ বিতর্কিত চুক্তির শর্তাবলি এবং বিদ্যুতের যে দাম দেওয়া হয়েছে তা যুক্তিযুক্ত কি না সে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, বিদ্যুৎ খাতের প্রতিটি প্রকল্পই যাচাই করা হচ্ছে। এ ছাড়া আরও অনেক বিষয়ে সংস্কার আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিভিন্ন কোম্পানিতে বদলি-তদবির, অনিয়ম বন্ধে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সামিট গ্রুপের তৃতীয় এলএনজি টার্মিনালের কাজ পাওয়া নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, সেটাও পর্যালোচনা করা হবে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
এদিকে বিগত সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন করছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গুরুত্ব বিবেচনা করে যেসব প্রকল্পকে বিলাসী প্রকল্প বিবেচনা করা হবে, সেগুলো ধীরগতিতে এগোবে অথবা আপাতত স্থগিত থাকবে।