কাঙ্ক্ষিত গতি ফেরাতে আরও সময় লাগবে

এম এইচ রবিন
০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
কাঙ্ক্ষিত গতি ফেরাতে আরও সময় লাগবে

অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাসেও কাঙ্ক্ষিত গতি ফিরেনি জনপ্রশাসনে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর স্থবির প্রশাসনে শূন্য থেকে শুরু করতে হয় অন্তর্বর্তী সরকারকে। প্রশাসন ঢেলে সাজাতে চুক্তি বাতিল, চুক্তিতে নতুন নিয়োগ, পদোন্নতি-পদায়ন নিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে ডিসি পদায়নে ঘুষের অভিযোগ ওঠায় সৃষ্টি হয় বিতর্ক। যারা প্রশাসন সাজাচ্ছেন, তাদের অভিজ্ঞতার ঘাটতি নেই। তবে বয়সের বিষয়টি বাধা হতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। প্রশাসনের গতি আর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আরও সময়ের প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এর মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দাখিল, জনপ্রশাসন সংস্কার এবং চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করার উদ্যোগকে ইতিবাচক দেখছেন তারা।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত দুই মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে। তাদের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) এবং অনেককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হচ্ছে। আবার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিভাগে চুক্তিতে সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অবসরে যাওয়া ’৮২ ব্যাচের ৬ সিনিয়র কর্মকর্তাকে। পাশাপাশি আওয়ামী শাসনামলে ‘বঞ্চিত’ বিভিন্ন পর্যায়ের বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। সংস্কার পদক্ষেপের অংশ হিসেবে গত দুই মাসে জনপ্রশাসনে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব ও উপসচিব পদে পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি, শতাধিক কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল এবং বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে ওএসডিও করা হয়েছে।

এদিকে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের সচিব কিংবা জেলা প্রশাসকের (ডিসি) মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে। বিশেষ করে ডিসি নিয়োগ নিয়ে সচিবালয়ে নজিরবিহীন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন কর্মকর্তারা। তারা হাতাহাতিতেও জড়িয়েছেন। তদন্ত করে এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে তড়িঘড়ি করে পদোন্নতি ও পদায়ন করতে গিয়ে নানা ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি হচ্ছে। অনিয়মে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদেরও পদোন্নতি পেতে দেখা গেছে। যে কারণে ভুল শুধরে বারবার সিদ্ধান্ত বদলাতে হচ্ছে।

জানা গেছে, সচিবসহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পদায়নের বিষয়টি এখনও চলমান। সম্প্রতি অবসরে যাওয়া খাদ্য ক্যাডারের এক কর্মকর্তাকে খাদ্য সচিব নিয়োগ দেওয়ার একদিন পর তা বাতিল করা হয়। আরেক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে নৌসচিব নিয়োগের দুদিন পর ওএসডি করা হয়। যাচাই-বাছাই করে নিয়োগ না দেওয়ার কারণে সিদ্ধান্ত বদলাতে হচ্ছে বারবার। বিশেষ করে সম্প্রতি ডিসি নিয়োগ কেন্দ্র করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস-উর-রহমানের বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ ওঠায় বিতর্কের জন্ম নেয়। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ সিনিয়র সচিবের হোয়াটসঅ্যাপে কথোপকথনের স্ক্রিনশটও প্রকাশ করা হয়। তবে ডিসি নিয়োগ কেন্দ্র করে অর্থের লেনদেনের অভিযোগ নিয়ে খবরটি ‘ভুয়া’ বলেছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস-উর-রহমান। একই সঙ্গে যে অভিযোগ উঠেছে তা মূল্যহীন বলে নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেন তিনি। এর মধ্যেই প্রশাসনের ভালো একটি উদ্যোগ প্রশংসা পাচ্ছে সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়টি। একই সঙ্গে উপদেষ্টাদেরও সম্পদের হিসাব দিতে বলা হয়। এ জন্য একটি নীতিমালা করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রশাসন সংস্কারে সাবেক সচিব ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মূয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি চাকরিপ্রার্থীদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির দাবি ইতিবাচক হিসেবে নিয়ে এটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য মূয়ীদ চৌধুরীকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সরকারের দুই মাস নিয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা বলছেন, যে পরিস্থিতিতে এ সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, সেই অবস্থানে থেকে প্রশাসনে স্থিতিশীল আনার জন্য দুই মাস খুবই অল্প সময়। দাবি-দাওয়া, আন্দোলন তাদের অনেকটাই নাজেহাল করেছে। প্রশাসনের পরিস্থিতি এখনও সন্তোষজনক নয়, গতিও ধীর।

সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান আমাদের সময়কে বলেন, সময় আরও যাক, একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এ সরকার কাজ শুরু করেছে। সেই কারণে হয়তো কাক্সিক্ষত স্পিরিটে প্রশাসন কাজ করেনি। এখন নানাবিদ পদক্ষেপের কারণে প্রশাসনে গতি আসবে। যারা প্রশাসন চালাচ্ছেন, তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি কানায় কানায় পরিপূর্ণ বলে মনে করেন সাবেক এ সচিব।

প্রশাসনের অবস্থা জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও উপদেষ্টা এবং সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, প্রশাসনে এখন যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে, শিগগিরই সেটি কেটে গিয়ে কাজেও গতি ফিরবে। দলীয়করণের কারণে প্রশাসনে যে বড় ক্ষতি হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার তা কাটিয়ে উঠে পুনরায় নিয়মের মধ্যে আনার চেষ্টা করছে। তবে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আরও সময় লাগবে। প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ও জনবান্ধব করতে যা যা ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন সবই সরকার গ্রহণ করছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। ওই দিনই বিলুপ্ত হয় মন্ত্রিসভা। পর দিন ৬ আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি। এরপর গত ৮ আগস্ট শপথ নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেত্বত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। নিয়োগ পান ১৬ উপদেষ্টা। পরে আরও চার উপদেষ্টা সরকারে যুক্ত হন।