স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে শতকোটি টাকার কমিশন বাণিজ্য
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গত তিন অর্থবছরে ৩১৮ কোটি টাকার চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী কেনাকাটায় শতকোটি টাকার কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অধিদপ্তরের একটি সিন্ডিকেট এসব চিকিৎসা উপকরণ সরবরাহে নিয়োজিত কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে কার্যাদেশ প্রদানের আগেই কমিশনের অর্থ হাতিয়ে নিত। এমনকি লুটপাটের সুবিধার জন্য এক বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ দামে যন্ত্রপাতি কেনার তথ্যও পাওয়া গেছে। এসব অপকর্মের নেপথ্যে ছিলেন তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ছেলে রাহাত মালেক (শুভ্র) এবং তার প্রধান সহযোগী ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর মাজহারুল হক (তপন)। দুর্নীতির অভিযোগে এ বছরের শুরুতেই তাকে তাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে অন্যত্র বদলি করা হয়। বর্তমানে এই পদে বসা নতুন লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলামের বিরুদ্ধেও বরাদ্দ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে।
প্রতি প্যাকেজে ২৫ শতাংশ কমিশন : অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ও সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ করা প্রায় প্রতিটি কোম্পানি থেকে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন নেওয়া হয়েছে, যার ১২ থেকে ১৫ শতাংশ চলে যায় রাহাতের পকেটে। বাকি ৫ থেকে ৮ শতাংশ পান সাবেক লাইন ডিরেক্টর মাজহারুল। বর্তমানে এইচএসএমের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম। সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো বলছে, তাকেও প্রতি প্যাকেজে ১৫ শতাংশ এবং অন্যান্য কর্মকর্তাকে ৫ শতাংশ কমিশন দিতে হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ৩১৮ কোটি ৮৭ লাখ ৫৮ হাজার
৬৮৮ টাকার যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়। এর মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৪২ কোটি ৮০ লাখ ৪৩ হাজার ২০০ টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১১৯ কোটি ১০ লাখ ৮৮ হাজার ১৭২ টাকা এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫৬ কোটি ৯৬ লাখ ২৭ হাজার ৩১৬ টাকা ব্যয় হয়। এসব কেনাকাটার ৯০ শতাংশ হয়েছে মাজহারুল হকের নেতৃত্বে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে জানান, কারা কাজ পাবেন সেটি নির্ধারণ করে দিতেন রাহাত। নির্দিষ্ট কোম্পানি ছাড়া দরপত্রে কেউ যাতে অংশ নিতে না পারে, সে অনুযায়ী স্পেসিফিকেশন তৈরি করতেন মাজহারুল। ফলে একই কোম্পানি বারবার কাজ পেয়েছে। কাজ পাওয়া প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কাজ শুরুর আগেই কাজ পাইয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কমিশন নেওয়া হতো। এভাবে প্রায় ৮০ কোটি টাকা হাতানো হয়েছে, যার ৭০ কোটি গেছে রাহাতের পকেটে। অন্তত ১০ কোটি পান মাজহারুল ।
তারা বলেন, যতদিন দপ্তরে আছেন, টাকা ছাড়া কোনো কাজ দেবেন না বলে ঘোষণা দেন মাজহারুল। লেনদেনের এসব টাকা রাহাতের বারিধারার বাসা, বনানীর অফিস এবং গুলশানের একটি পার্কে তৃতীয় পক্ষের একজন বস্তা ভরে গাড়িতে রেখে আসত।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ওই দুই কর্মকর্তা আরও বলেন, আনিফকো হেলথকেয়ার, ট্রেড হাউস, বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস, ডায়ামেট, নিউ টেক জিটি লিমিটেড ও টেকনোওয়ার্থ অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগসাজশ ছিল রাহাত মালেক ও মাজহারুলের। টাকা নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি দল দেখতেন না, যারা বেশি দেবে তারাই কাজ পাবে-এটাই ছিল তার নীতি।
এই দুই কর্মকর্তার বক্তব্যের মিল পাওয়া যায় এমআরআই, সিটি স্ক্যানের মতো ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীর ভাষ্যে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের সময়কে তিনি বলেন, অধিদপ্তরে কাজ পেতে হলে টাকা দেওয়া বাধ্যতামূলক। কাজ পাওয়ার আগেই প্যাকেজপ্রতি অগ্রিম লভ্যাংশের ২৫ শতাংশ দিতে হয়। বড় অংশ নিতেন জাহিদ মালেকের ছেলে রাহাত, বাকি অংশ লাইন ডিরেক্টর মাজহার। তিনি বলেন, অভিযোগ পাওয়ায় মাজহারকে সরানো হলেও থেমে নেই দুর্নীতি। বর্তমান লাইন ডিরেক্টের নাজমুল ইসলামকেও ১৫ শতাংশ ও অন্যান্য কর্মকর্তাকে ৫ শতাংশ কমিশন দেওয়া লাগে।
এ দুই কর্মকর্তাই আওয়ামী লীগপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপের) শীর্ষনেতা। জানা গেছে, গণ-অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সরাসরি অংশ নেন মাজহার ও নাজমুল। এর মধ্যে নাজমুল শেখ হাসিনার পালানোর আগের দিনও সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে অধিদপ্তরে রাজনৈতিক মিছিলের নেতৃত্ব দেন।
কাগজে স্বাক্ষর করেই বছরে হাতানো ২০ কোটি : জেলা সদর হাসপাতালে সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক আমাদের সময়কে বলেন, সদর হাসপাতালে বরাদ্দ পেতে ন্যূনতম ১০ শতাংশ কমিশন দিতে হয়। বিভাগীয় মেডিক্যাল ও বিশেষায়িত হাসপাতালে এই হার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। শুধু কাগজেই স্বাক্ষর দিয়েই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টরসহ অন্য কর্মকর্তারা বছরে ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
দুর্নীতি টের পেয়ে মাজহারকে সরিয়ে দেন সামন্ত লাল : দায়িত্ব নিয়ে অধিদপ্তরের বিভিন্ন জায়গায় হাত দেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়টি জানতে পেরে গত ১৩ মার্চ মাজহারুলকে লাইন ডিরেক্টরের পদ থেকে সরিয়ে দেন তিনি। বর্তমানে তিনি রাজধানীর জাতীয় অর্থপেডিকস হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) ব্ল্যাড ট্রান্সমিশন বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন।
এক বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ দামে যন্ত্র ক্রয়: অনিয়মের বড় অংশ সংঘটিত হয়েছে যন্ত্রপাতি কেনাকাটায়। এক বছরের ব্যবধানে অনেক যন্ত্রই কেনা হয়েছে দ্বিগুণ দামে। আল্ট্রাসনোগ্রাম ফোর ডি কালার ডোপলার ২০২০ সালে ২৯ লাখ টাকায় কেনা হলেও একই যন্ত্র পরের বছর কেনা হয় প্রায় ৬০ লাখ টাকায়। এমন ১০টি আল্ট্রাসনোগ্রাম যন্ত্র কেনা হয়েছে, যেখানে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬ কোটি টাকা। একইভাবে ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকার আইসিইউ বেড ৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা, দুই লাখ ৭০ হাজার পেশেন্ট মনিটর কেনা হয়েছে ৫ লাখ টাকায়। এ ছাড়াও ৮৫ হাজার টাকার ইনফিউশন পাম্প ১ লাখ ২৯ হাজার টাকা, ৮০ হাজার টাকার সিরিং পাম্প কেনা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার টাকায়।
পালিয়েছেন জাহিদ মালেক ও ছেলে রাহাত : গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাহাত মালেকের বাবা সাবেক সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। তবে সেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই এখন দেশের বাইরে তিনি। তার দুর্নীতি-অপকর্ম খতিয়ে দেখছে দুুুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকে অভিযোগ জমা পড়েছে ছেলে রাহাতের বিরুদ্ধেও।
এসব অনিয়মের বিষয়ে বক্তব্য নিতে গত ১ অক্টোবর রাহাতের মালিকাধীন বনানীর বিটিএ টাওয়ারে গেলে সেখানকার কর্মকর্তারা জানান, সর্বশেষ ২৫ জুলাই এক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন রাহাত। এরপর থেকেই তিনি দেশের বাইরে। তবে রাহাতের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ফোন নম্বর বা ইমেইল ঠিকানা চাইলেও তারা দিতে পারেননি।
দায় নিতে নারাজ মহাপরিচালক খুরশীদ আলম : অভিযোগ রয়েছে, এসব সাগরচুরি দেখেও পদ বাঁচাতে চুপ ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তবে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘এমন অনিয়মের বিষয়টি আমার নজরে আসেনি অথবা তারা আমার কাছ থেকে হাইড (গোপন) করেছে। এসব কেনাকাটার আলাদা টেন্ডার কমিটি আছে। অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) এই কমিটির প্রধান। কমিটিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুজন যুগ্ম সচিবও রয়েছেন। যদি অনিয়ম হয়ে থাকে তারাই বলতে পারবেন।’
যা বলছেন অভিযুক্তরা: অভিযুক্ত এইচএসএমের সাবেক লাইন ডিরেক্টর মাজহারুল হক আমাদের সময়কে বলেন, সব কেনাকাটা ইজিপিতে স্বচ্ছতার সঙ্গে হয়েছে। দরপত্র সঠিকভাবে মূল্যায়নের পর মহাপরিচালকের অনুমোদনে সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ বাণিজ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো কোম্পানি যদি বলতে পারে তাদের কাছ থেকে কোনো টাকাপয়সা নিয়েছি, তাহলে যে শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেব। দ্বিগুণ দামে যন্ত্র কেনাকাটার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমার লক্ষ্য ছিল ভালো মানের যন্ত্র কেনা। সঙ্গে ডলারের উচ্চমূল্যের বিষয় ছিল।’
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
আরেক অভিযুক্ত বর্তমান লাইন ডিরেক্টর নাজমুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলতে টানা দুদিন অধিদপ্তরে তার কার্যালয়ে গেলেও পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে অসংখ্যবার যোগাযোগের চেষ্টা এবং হোয়াটসঅ্যাপে অভিযোগ লিখে পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, শুধু স্বাস্থ্য নয়, সরকারি প্রতিটি খাতেই কেনাকাটায় এমন দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। ত্রিমুখী আঁতাতের মাধ্যমে এসব অনিয়ম হয়ে আসছে। এমন দুর্নীতি হওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধান যদি বলেন তিনি জানেন না, তার নজরের বাইরে এমন কার্যাদেশ হয়েছে, এটা হতে পারে না। তিনি বলেন, নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে এটাকে (আঁতাত) ভাঙতে হবে। ইতোমধ্যেই সেই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে এই খাত এখনও বাকি রয়েছে। এটাকে রোধ করতে হলে রাজনীতিক, ব্যবসায়িক ও আমলাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।