স্বর্ণ চোরাচালানের সিন্ডিকেট বিমানের বিএফসিসিতে

তাওহীদুল ইসলাম
০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
স্বর্ণ চোরাচালানের সিন্ডিকেট বিমানের বিএফসিসিতে

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পাশাপাশি বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোয় খাবার পরিবেশন ও কেবিন ড্রেসিংয়ের দায়িত্ব পালন করে বিমান ফ্লাইট ক্যাটারিং সেন্টার-বিএফসিসি। প্রয়োজনীয় খাবার ফ্লাইটে পৌঁছে দিতে কর্মীরা ব্যবহার করেন বিমানবন্দরের অ্যাপ্রোন এলাকার লাগোয়া বিএফসিসির পেছনের গেট। এ সুযোগে হাতবদল করা হয় চোরাচালানের বিভিন্ন পণ্য। পরে বিএফসিসির সামনের গেট হয়ে চত্বরের বাইরে চলে আসে সেসব স্বর্ণ। এসব কর্মকা- করতে গড়ে উঠছে একটি সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চালানো হচ্ছে তাদের অপকর্ম।

দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা, অপর্যাপ্ত নিরাপত্তাকর্মী, অপরিসর নিরাপত্তা গেট ও নিজস্ব লোক দিয়ে নামমাত্র চেকিংয়ের সুযোগে বিএফসিসিতে গড়ে উঠেছে সোনা পাচারের নিরাপদ ক্ষেত্র। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন পর্যায়ের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সিন্ডিকেট এই পথে নির্বিঘেœ পাচার করছে সোনা। বিমানের তদন্ত প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে এসব তথ্য। বিভিন্ন সময় পাচারের স্বর্ণসহ বিমানের কর্মী আটক হলেও মূল অপরাধীরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। এবারের তদন্ত প্রতিবেদনেও তাদের শাস্তির আওতায় আনার সুপারিশ নেই।

গত ২ সেপ্টেম্বর বিমানের পেন্ট্রিম্যান (সিসি-৩৯২) জাহাঙ্গীরের দেহ তল্লাশি করে স্বর্ণবার উদ্ধারের ঘটনায় ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বিএফসিসি।

উপ-মহাব্যবস্থাপক নজরুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটিতে ব্যবস্থাপক ফুড অ্যান্ড হাইজিন জাফর আহমেদ, উপ-ব্যবস্থাপক সম্ভার ও ক্রয় ছাদেকুজ্জামান চৌধুরীকে সদস্য এবং নিরাপত্তা বিভাগের উপব্যবস্থাপক বিএম ইকবাল আনোয়ারুল ইসলাম ছিলেন সদস্য সচিব। গত ২৪ সেপ্টেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কমিটি। ২০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের সঙ্গে আরও ৮০ পৃষ্ঠা ছিল সংশ্লিষ্ট কাগজ। স্বর্ণ পাচারের সময় বিএফসিসির

এক কর্মী আটকের ঘটনায় প্রকাশিত হয়েছে এই সিন্ডিকেটের অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। ইতিমধ্যে বিএফসিসির মহাব্যবস্থাপক ইকবাল আহমেদ আলীজাকে বিএফসিসির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গত ১৫ সেপ্টেম্বর তাকে বদলি করা হয় স্টোরস অ্যান্ড মেটেরিয়াল ম্যানেজমেন্ট বিভাগে।

বিএফসিসির কর্মী জাহাঙ্গীর আলমের আগে ২০২২ সালের ২৫ মে মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ আকন্দকে ৮ কেজি সোনার বারসহ আটক করে ঢাকা কাস্টম হাউস। সোনা পাচারের দুটি ঘটনা ধরা পড়লেও প্রকৃত পাচার আরও বেশি। অভিযোগ আছে, সদ্য অব্যাহতি পাওয়া বিএফসিসির মহাব্যবস্থাপক ইকবাল আহমেদ আলীজা ২০২০ সাল থেকে নিজের বলয়ের কর্মীদের অন্য বিভাগ থেকে এনে গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট। যদিও তিনি তা অস্বীকার করেছেন।

বিমানের এই ইকবাল আহমেদ আলীজা আমাদের সময়কে বলেন, কাস্টমস ইন্টেলিজেন্সসহ গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা স্বর্ণ চোরাচালান ধরেন। কারা জড়িত কীভাবে এসব অপকর্ম করে তা তারাই ভালো বলতে পারবেন। আমার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ভিত্তিহীন। এটি কর্মচারী লেভেলের কেউ করে থাকতে পারে, যা ধরাও পড়েছে।

এদিকে বিএফসিসির কর্মী জাহাঙ্গীর আটকের ঘটনা তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অনুগতদের বাঁচাতে নিয়মবহির্ভূতভাবে সিসিটিভির পাসওয়ার্ড নিজের আয়ত্তে নেওয়ার অভিযোগ তোলে একটি অংশ। মাংস ক্রয় প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগও পাওয়া গেছে তদন্তে। এ ছাড়া নিরাপত্তা তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে একজন নারী সহকর্মীকে হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের লিখিত অভিযোগ দিলেও ব্যবস্থা নেয়নি তৎকালীন কর্তৃপক্ষ। নতুন পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব নেওয়ার পর এসব অনিয়মের তদন্ত শুরু করে।

দায়িত্ব নেওয়ার পর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাফিকুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, বিমানের সব অনিয়মের তদন্ত করা হবে।

বিমান সূত্র জানিয়েছে, উড়োজাহাজের পরিচ্ছন্নতা ও খাবার পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে কৌশলে সোনা চোরাচালানের অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দুবাই থেকে বিমানের ফ্লাইট ঢাকায় এলে ক্যাটারিংয়ের মালামাল অফলোড ও কেবিন ড্রেসিংয়ে উড়োজাহাজে প্রবেশ করে বিএফসিসির কর্মী জাহাঙ্গীর আলম। এ সময় একটা সিটের নিচ থেকে কালো টেপ জড়ানো দুটো প্যাকেট নিয়ে পায়ে আটকানো রাবারের বেল্টে লুকিয়ে ফেলেন। কেবিন ড্রেসিং না করেই ক্যাটারিংয়ের মালমাল নিয়ে বের হয়ে আসেন। নিরাপত্তাকর্মীদের বাধা ছাড়াই এয়ারসাইড গেট নির্বিঘেœ পার হলেও ল্যান্ডসাইড গেটে দেহ তল্লাশিতে ধরা পড়ে ৪ কেজি স্বর্ণ। ডিউটি রোস্টার থেকে শুরু করে উড়োজাহাজে ওঠা, কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে আসা, ডিউটি শেষ হওয়ার আগে বিএফসিসির বাইরে আসার চেষ্টা- এর প্রতিটি ধাপেই সহযোগিতা করেছে সংশ্লিষ্টদের কেউ না কেউ।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএফসিসি ব্যবস্থাপক আলীজার ব্যাপারে বলা হয়েছে, তিনি নিজেই খাবার অবৈধভাবে নিয়ে বের হয়েছেন। তাই অন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অভিযোগ আসায় তিনি ক্ষুব্ধ হন।

বিএফসিসির খাবার প্যাকেটের মাধ্যমেও পাচারের সোনা কিংবা মাদকের মতো অবৈধ দ্রব্য বিনা চেকিংয়ে বাইরে চলে আসে। বিএফসিসির সাবেক মহাব্যবস্থাপকসহ তার অনুগতদের নিয়মবহির্ভূতভাবে চেকিং ছাড়া খাবার বিএফসিসির বাইরে আনার অভিযোগ উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। চেকিং ও ভাউচার ছাড়া খাবারের বক্স বাইরে আনার ঘটনার তদন্ত করায় নিরাপত্তাকর্মীদের হয়রানি ও শোকজ করা হয়। নিরাপত্তাকর্মীদের পাশ কাটাতে বিএফসিসির সিসিটিভি সার্ভারের পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে আলীজা বলেন, এ তথ্যটি সঠিক নয়। তা ছাড়া এডমিন পাসওয়ার্ড পরিবর্তন দূরের কথা, নিজেরাই জানি না। ইউজার পাসওয়ার্ড ব্যবহার করি আমরা।

পেন্ট্রিম্যান জাহাঙ্গীর আলম, জুনিয়র নিরাপত্তা কর্মকর্তা এনামুল হক মৃধা, সিনিয়র অপারেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট বদিউজ্জামান, পেন্ট্রিম্যান মোজাম্মেল হক ও ক্যাজুয়াল পেন্ট্রিম্যান সাহিদুল ইসলামের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত থাকার বিষয়ে প্রত্যক্ষভাবে প্রমাণ না হলেও তারা প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। হেড পেন্ট্রিম্যান ইউনুস সিরাজ ও ডেপুটি হেড পেন্ট্রিম্যান শামসুল আলম পাটোয়ারির ব্যাপারে বলা হয়েছে- এ দুজন অযোগ্য, অদক্ষ এবং দায়িত্বহীন।

এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চোরাচালান বন্ধে নিরাপত্তা গেট বড় করা ও নিরাপত্তাকর্মী বাড়াতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একাধিক মিটিংয়ের পরও ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ এসেছে। তদন্তে ১৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর জাহাঙ্গীরসহ দুজন অভিযুক্ত ও পাঁচজন সন্দেহভাজনকে চিহ্নিত করে কমিটি। তবে চোরাচালানে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ নেই। বিএফসিসিকে ঘিরে চোরাচালানসহ বিভিন্ন অভিযোগে বিএফসিসি প্রশাসনের পর বিমান প্রশাসনেরও দুই সদস্যের কমিটির তদন্ত চলছে।