বেসিক ব্যাংকে লোকসান বেড়ে হয়েছে তিনগুণ
বছর যায়, বছর আসে। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয় না। প্রতি বছর মোট আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় লোকসান গুনছে ব্যাংকটি। সর্বশেষ ২০২৩ সালে ব্যাংকটির লোকসান বেড়ে তিনগুণ হয়েছে। সব মিলিয়ে গত ১১ বছরে বেসিক ব্যাংকের নিট লোকসান সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। মূলত সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর সময়ে নজিরবিহীন ঋণ জালিয়াতির পর ব্যাংকটি খাদের মধ্যে পড়ে। বিভিন্ন সময়ে সরকার থেকে এই ব্যাংককে ২ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার মূলধন সহায়তা দেওয়া হয়। সমঝোতা স্মারকের আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে। তার পরও ব্যাংকটির প্রায় সব সূচকই নেতিবাচক। বর্তমানে উচ্চ খেলাপি ঋণের পাশাপাশি বিপুল অঙ্কের প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি রয়েছে ব্যাংকটিতে। তারল্য সংকটে নতুন ঋণ বিতরণ এক প্রকার বন্ধ রয়েছে। এমন অবস্থায় সর্বশেষ ব্যাংকটিকে বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে আপত্তি জানিয়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আবদুল হাই বাচ্চু বেসিক ব্যাংক ছেড়ে যাওয়ার পর প্রায় ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও আর্থিক সংকট থেকে বের হতে পারেনি ব্যাংকটি। এর মধ্যেই বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের মাধ্যমে বেসিক ব্যাংক বেসরকারি মালিকানায় চলে যাচ্ছে- এমন খবর গণমাধ্যমে আসার পর থেকে ব্যাংকটি থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার আমানত তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে তারল্যে আরও চাপ সৃষ্টি হয়। ফলে এখন কার্যক্রম চালাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিয়মিত ধার করে চলতে হচ্ছে ব্যাংকটিকে। মূলত আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় দিন দিন অবস্থার অবনতি হচ্ছে বেসিক ব্যাংকের।
বর্তমানে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন আনোয়ার খান মডার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. আবুল হাসেম। ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে ৩ বছরের জন্য নিয়োগ পান তিনি। প্রথম মেয়াদ শেষ হওয়ার দুই মাস পর গত বছর ১৫ নভেম্বর আবার ৩ বছরের জন্য তাকে পুনঃনিয়োগ দেয় তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার। বেসিক ব্যাংকের আর্থিক
অবস্থার অবনতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ড. আবুল হাসেম মন্তব্য করতে রাজি হননি।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
বেসিক ব্যাংকের সর্বশেষ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন মো. আনিসুর রহমান। গত সপ্তাহে অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) সঙ্গে তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও বাতিল করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ২০২১ সালের এপ্রিলে তিন বছরের জন্য এমডি হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। প্রথম মেয়াদ শেষ করার পর তাকেও পুনঃনিয়োগ দেওয়া হয়।
২০২৩ সালে ব্যাংকটির লোকসান বাড়ার কারণ জানতে চাইলে সাবেক এমডি আনিসুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, আমানতের সুদ বাড়ায় গত বছর আমাদের কস্ট অব ফান্ড অনেক বেড়ে গিয়েছিল। আমাদের আমানতের বড় অংশই প্রাতিষ্ঠানিক। প্রতিবছর আমানতের সুদ বাবদ ৮০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয়। অন্যদিকে ব্যাংকের রয়েছে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ। এগুলো সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর আমলের। এসব খেলাপি ঋণ থেকে তেমন কোনো আদায় নেই। নতুন ঋণ বিতরণও বাড়েনি। ফলে কমে গেছে সুদ-আয়। অন্যদিকে সুদ-ব্যয় কমেনি। আর সুদ-আয় ও সুদ-ব্যয়ের ব্যবধানটাই হলো লোকসান। যে বছরে খেলাপি ঋণ থেকে আদায় বেশি, সেই বছর নিট লোকসান কম। তবে আমাদের আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা ভালো হয়েছে। ফলে চলমান ডলার সংকটের সময়েও বেসিক ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার না নিয়েই স্বাভাবিক ব্যবসায়িক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়। এ ছাড়া চলমান পরিস্থিতিতে আমাদের কোনো গ্রাহকের চেক প্রত্যাখ্যাত হয়নি।
সূত্র জানায়, ১৯৮৯ সালে যাত্রা শুরু করা বেসিক ব্যাংক এক সময় দেশের সেরা ব্যাংকের তালিকায় ছিল। কিন্ত ২০০৯-২০১৩ সালের মধ্যে বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণের নামে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়। তখন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইউর তদন্তে উঠে আসে জাল দলিলে ভুয়া ও ঠিকানাবিহীন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে বেশির ভাগ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। ২০১৩ সালেই এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দুদকে পাঠানো হয়। এরপর অনুসন্ধানে নামে দুদক। প্রথম দিকে দুদকের মামলায় আবদুল হাই বাচ্চুকে বাদ দেওয়া হলেও পরে আসামি করা হয়েছে। গত বছর জুনে বাচ্চুসহ ১৪৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে ৫৯টি মামলার অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে দুদক। এর মধ্যে ৫৮টি মামলাতেই বাচ্চু অভিযুক্ত। তবে তিনি এখন কোথায় আছেন কেউ বলতে পারছেন না।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
বেসিক ব্যাংকে বর্তমানে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক। বেসিক ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিষয়টি নিয়ে মুখপাত্রের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। যোগাযোগ করা হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র হুশনে আরা শিখা আমাদের সময়কে বলেন, আর্থিক অনিয়মসহ বিভিন্ন কারণে এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। আপাতত এই ১১টি ব্যাংকে মোটামুটি একটা পর্যায়ে নিয়ে অন্যান্য দুর্বল ব্যাংকের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
লাগামহীন খেলাপি ঋণ : গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৮ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৬৩.৩৫ শতাংশ। চলতি বছর জুন শেষে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে হয়েছে ৮ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা বা ৬৪.৪৫ শতাংশ। একই সময়ে সার্বিক ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার ১২.৫৬ শতাংশ।
প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি কমছে না : উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে বর্তমানে ব্যাংকটি বড় ধরনের প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে। গত বছর ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি ছিল ৫ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুনে প্রভিশন ঘাটতি আরও বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ২৪১ কোটি টাকা। অন্যদিকে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের কারণে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ব্যাংকটি প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না। গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংটির মূলধন ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা। আগের বছর ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি যে পরিমাণ দেখানো হচ্ছে, তার তুলনায় প্রকৃত ঘাটতি দ্বিগুণের বেশি বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
লোকসান বাড়ছেই : গত বছর বেসিক ব্যাংকের লোকসান বেড়ে হয়েছে ৪১৬ কোটি টাকা। এটি একক বছর হিসেবে এযাবৎকালের তৃতীয় সর্বোচ্চ। আগের বছর নিট লোকসান হয়েছিল ১৩০ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকটির সবচেয়ে বেশি লোকসান হয় ২০১৬ সালে। সে বছর লোকসানের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া ২০২১ সালে নিট লোকসান হয় ৩৯৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া ২০২০ সালে ৩৭১ কোটি, ২০১৯ সালে ৩২৬ কোটি, ২০১৮ সালে ৩৫৩ কোটি, ২০১৭ সালে ৬৮৪ কোটি, ২০১৫ সালে ৩১৪ কোটি, ২০১৪ সালে ১১০ কোটি ও ২০১৩ সালে ৫৩ কোটি টাকার লোকসান করে ব্যাংকটি। সব মিলিয়ে ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১১ বছরে বেসিক ব্যাংকের নিট লোকসান হয়েছে ৪ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা।