ফেনী ছিল নিজাম হাজারীর সন্ত্রাসের সাম্রাজ্য

শাহজাহান আকন্দ শুভ, ঢাকা ও মুহাম্মদ আরিফুর রহমান, ফেনী
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ফেনী ছিল নিজাম হাজারীর সন্ত্রাসের সাম্রাজ্য

ফেনীর রাজনীতিতে সন্ত্রাসের মদদদাতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী। এক সময় জয়নাল হাজারীর হাত ধরে চট্টগ্রাম থেকে ফেনীতে পা রাখেন তিনি। এরপর গুরুকে হটিয়ে ফেনীর একচ্ছত্র আধিপত্য গড়েন নিজাম। কায়েম করেন ত্রাসের রাজত্ব। প্রথমে ফেনী পৌরসভার মেয়র হন। এরপর তিনবার সংসদ সদস্য। বাগিয়ে নেন ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদও। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের আগ পর্যন্ত ছিলেন ফেনীর সর্বময় ক্ষমতার অধিপতি। সরকার পতনের পর সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যান ভারতে। সেখান থেকে দুবাই। বর্তমানে সেখানেই অবস্থান করছেন বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

জানা গেছে- দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অস্ত্র ব্যবসাসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে গত ১৫ বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়ে তোলেন নিজামী হাজারী। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার দখলে নেওয়া চক্রের সাবেক ৪ এমপির মধ্যে তিনি অন্যতম। চক্রটি দেড় বছরে ২৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে বলে দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে। ২০১৪ সালের ২০ মে ফেনীতে দিন-দুপুরে গুলি ও গাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামকে হত্যা করা হয় এমপি নিজামের ইশারায়। এভাবে আরও অনেক লাশ পড়ে। কিন্তু সব সময় নিজামী হাজারী ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত ৪ আগস্ট তার নির্দেশে ফেনীতে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করা হয়। এতে ১১ জন নিহত হয়। ওই ঘটনায় নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে ৮টি হত্যা মামলা হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে নিহতদের পরিবার।

নিজাম হাজারীর রাজনীতি জয়নাল হাজারীর হাত ধরে হলেও উত্থান চট্টগ্রামের আ জ ম নাছিরের মাধ্যমে। চট্টগ্রামে অস্ত্রের কারবারি ছিলেন নিজাম। ২০০১ সালে যৌথ বাহিনীর অভিযানের মুখে জয়নাল হাজারী এলাকা ছাড়েন। এতে অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ে ফেনী আওয়ামী লীগ। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে আওয়ামী রাজনীতির হাল ধরতে চট্টগ্রাম থেকে ফেনী আসেন নিজাম হাজারী। তৈরি করেন নিজের ক্যাডার বাহিনী। একপর্যায়ে কোণঠাসা করে দেন গুরু জয়নাল হাজারীকেও। এরপর প্রভাব এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, তাকে চাঁদা না দিয়ে ফেনীতে থাকার উপায় ছিল না সিএনজিচালক থেকে শিল্পপতি পর্যন্ত।

বিভিন্ন সূত্রের তথ্য, নিজাম হাজারীর নামে ফেনীতে প্রতিদিন উঠানো হতো কোটি টাকার বেশি চাঁদা। তাকে কমিশন না দিয়ে কোনো উন্নয়ন কাজ হতো না। অগ্রিম কাজের টাকা দেওয়া এমন অনেক ঠিকাদার এখন বিপাকে পড়েছেন। ফারুক হোসেন নামে এক ঠিকাদার জানান, সড়কের দুই কোটি ৭৮ লাখ টাকার একটি কাজের জন্য নিজাম হাজারীকে অগ্রিম ৪০ লাখ টাকা দিয়েছেন। এখন তিনিও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

২০১১ সালে ফেনীর পৌর মেয়র নির্বাচিত হন নিজাম হাজারী। ২০১৪ সালে মেয়র পদ ছেড়ে দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে ফেনী-২ আসনের এমপি নির্বাচিত হন। হলফনামায় নিজাম হাজারী ও তার স্ত্রী নূরজাহান বেগমের সম্পদ দেখিয়েছিলেন ৪ কোটি ১৩ লাখ ৬০ হাজার ৪৬৮ টাকার। এমপি হওয়ার পর ২০১৮ সালের নভেম্বরে তাদের সম্পদের পরিমাণ হয় ৩১ কোটি ৯৫ লাখ ৫৭ হাজার ২০২ টাকা। আর গত পাঁচ বছরে তাদের সম্পদ বেড়ে হয় ১২৪ কোটি ৬২ লাখ ৭৬ হাজার ২৪৩ টাকা। হলফনামায় উল্লেখ করা এই হিসাবের বাইরে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে তার। হলফনামায় তার কয়েকশ কোটি টাকা মূল্যের বাগানবাড়ি এবং বালিগাঁওতে থাকা শতকোটি টাকার সম্পদ দেখানো হয়নি। ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জায়গা, ফ্ল্যাট, প্লটের হিসাবও গোপন করা হয়েছে। তার মালিকানার জাহাজের কথাও আসেনি। তার এমপি পদের বৈধতা নিয়েও ছিল প্রশ্ন। যা গড়িয়েছে উচ্চ আদালতে। অভিযোগ রয়েছে, সাজাপ্রাপ্ত নিজাম হাজারী পুরো সাজা শেষ না করেই জালিয়াতির মাধ্যমে বেরিয়ে এসে জনপ্রতিনিধি হয়েছেন।

নিজাম হাজারীর নির্দেশে গুলি

৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিজাম হাজারীর নির্দেশে তার ক্যাডার বাহিনী নির্বিচারে গুলি করে। এতে ১১ জন নিহত হন। নিজাম হাজারীর পক্ষে তার বিশ^স্ত ক্যাডার শুসেন গুলির নির্দেশ দেন। আর শুসেনের অনুসারী জিয়া উদ্দিন বাবলুর গুলিতে অধিকাংশ ছাত্র-জনতা মারা যায়। সদর উপজেলার উত্তর ফাজিলপুর কলাতলী গ্রামের নিহত ছাত্র ছাইদুল ইসলামের বাবা রফিকুল ইসলাম বলেন, নিজাম হাজারী সেদিন নির্দেশ না দিলে আমার ছেলে মরত না।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মুহাইমিন তাজিম বলেন, মহিপালে জোহরের নামাজ পড়ছিলাম। নামাজ শেষের দিকে আমাদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়া হয়। পরে শুনেছি ট্রাংক রোডে নিজাম হাজারীর মহড়ার পর তার ক্যাডাররা গুলি করতে করতে মহিপাল আসে।

ফেনী জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি হাফেজ আহম্মদ বলেন, ‘আমি এলাকাতেই আছি। আওয়ামী লীগ করলেও অন্যায়, অত্যাচার, মানুষ হত্যা করিনি। এক ব্যক্তির নির্দেশে সেদিন ১১ জনকে হত্যা করা হয়েছে।’

নাম না প্রকাশ করার শর্তে পৌর আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘এমপিকে বারবার বলেছি মহিপালে আন্দোলনরতরা কিছুক্ষণ পর চলে যাবে। হামলার নির্দেশের দরকার নাই। কথা অগ্রাহ্য করে শুসেনকে দায়িত্ব দেন নিজাম হাজারী। শুসেন তার বাহিনী নিয়ে নির্বিচারে গুলি করে। এমপির কারণে আজ দলের সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। সেদিনের ১১ হত্যা না হলে আমরা এলাকায় থাকতে পারতাম। এখন বিদেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।’

সাজা কম খেটে বের হন নিজাম হাজারী

২০০০ সালের ১৬ আগস্ট অস্ত্র আইনের এক মামলায় নিজাম হাজারীর ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়। তিনি মাত্র ২ বছর ১০ মাস কম সাজা খেটে কারাগার থেকে মুক্তি পান। অবৈধভাবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন।

মডেল মসজিদের টাকাও মেরেছেন

ফেনী সদরের মডেল মসজিদের কাজ শুরু হয় চৌধুরী বাড়ির দরজায়। কাজের জন্য প্রাথমিকভাবে বরাদ্দ হয় ১৫ কোটি টাকা। সে টাকা থেকে কমিশন হিসেবে ৮৪ লাখ টাকা নেন নিজাম হাজারী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, কাজের জন্য নিজাম হাজারীর কাছে গেলে ১০% দাবি করে। সে জন্য আমরা কাজটি নিইনি। পরে ৭% হারে অগ্রিম নিয়ে রাজু নামে একজনকে দেওয়া হয়। তিনিও পালিয়েছেন। বর্তামানে কাজ বন্ধ।

টাকা জোগাড়ের মেশিন ছিলেন সাদেক, আদর ও শরীফ

জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে নিজাম হাজারীর নামে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি টাকা আসা শুরু হয় সকাল ৭টা থেকে। সে টাকা ২০২২ সালের আগে আসত সাদেকের কাছে। সাদেকের ভাষ্য, টাকার ভার বহন করতে করতে কোমর বাঁকা হয়ে যেত। এক সময় তাকে বাদ দেওয়া হয়। পরে দায়িত্ব পায় শরীফ ও আদর। নিজাম হাজারীর এখনও বহু সম্পত্তি আদর ও শরীফের নামে রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। শরীফ, আদরও পলাতক।

কয়েকশ কোটি টাকার বাগানবাড়ি পড়ে আছে

ফেনী শহরের মাস্টারপাড়া এলাকায় রয়েছে নিজাম হাজারীর আলিশান বাগানবাড়ি। সেখানে আছে দৃষ্টিনন্দন লেক, হ্যালিপ্যাড, সুইমিংপুল, মদের বার। বিশাল আয়তনের এই বাড়িতে সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতে পারত না। জাতীয় নির্বাচনে হলফনামায় বাগানবাড়ির তথ্য উল্লেখ করেননি তিনি। প্রায়শই ঢাকা থেকে শোবিজ তারকা এবং প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতারা এই বাগানবাড়িতে আসতেন। সরকার পতনের পর ক্ষুব্ধ জনতা এতে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।

হিন্দুদের জায়গা দখল

ফেনী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শেখ ফরিদ বাহার জানান, মাস্টারপাড়ার হিন্দুদের জায়গা দখল করে নিজাম হাজারী হাজার কোটি টাকার বাগানবাড়ি তৈরি করেছেন। ফেনী শহরতলি সহদেবপুরের বাসিন্দা সম্ভুু চক্রবর্তী বলেন, প্রথমে জায়গা দিতে রাজি হচ্ছিলাম না। পরে দুজন এসে বলে, জায়গা বিক্রি করে টাকা না নিলে জোর করে নিয়ে যাবে। ভয়ে রেজিস্ট্রি করে দিই। পরে নামমাত্র টাকা দিয়েছে।

বালিগাঁওতে হাজার হাজার একর জায়গা দখল

ফেনী সদর উপজেলার বালিগাঁও ইউনিয়নে নিজাম হাজারী কয়েক হাজার একর জায়গা দখল করেছেন মসজিদ-মাদ্রাসার নামে। তার এই সাম্রাজ্য দখলের নেপথ্যে ছিলেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শুসেন চন্দ্র শীল। নামমাত্র টাকায় এসব জমি দখল করা হয়।

ফেনীর পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমান বলেন, এখন পর্যন্ত নিজাম হাজারীর নামে ৮টি হত্যা মামলাসহ ৯টি মামলা হয়েছে। তার নামে নানা অপকর্মের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ধরার জন্য সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সেনাবাহিনীর ফেনী ক্যাম্পের প্রধান মেজর ফাহিম বলেন, বিভিন্ন অপরাধে নিজাম হাজারীর নাম আসছে। তাকে আইনের আওতায় আনতে সব চেষ্টা অব্যাহত আছে।