টাকার কুমির আমজাদ গৃহিণীর কাছ থেকে ধার নেন ৮০ লাখ টাকা

হামিদ উল্লাহ, চট্টগ্রাম
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
টাকার কুমির আমজাদ গৃহিণীর কাছ থেকে ধার নেন ৮০ লাখ টাকা


লালখান বাজার ইস্পাহানি মোড়ে রয়েছে ৮ তলা বাড়ি (জুলেখা ভবন, হোল্ডিং নম্বর ৬৭৪)। তবে তিনি থাকেন সামছি কলোনির ৪২ নম্বর বাড়িতে। পাশের হাই লেভেল রোডের শাহী দরবার সংলগ্ন স্থানে আছে একটি দোতলা ভবন ও টিনশেড ভাড়া ঘর। এ জায়গার নাম মোহাম্মদ আলী কন্ট্রাক্টর বাড়ি। লালখান বাজার বাঘঘোনা মসজিদের সামনে আছে আরো একটি টিনশেড ভবন। সাবেক কাস্টমস কর্মকর্তা ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা আমজাদ হোসেন হাজারীর এসব সম্পদের কাগুজে মালিক হলেন তার গৃহিণী হালিমা বেগম ওরফে লিপি।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সম্প্রতি আমজাদ হোসেন হাজারীর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেছে। গত ১১ সেপ্টেম্বর দুদক চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়-১ এর উপসহকারী পরিচালক আপেল মাহমুদ বিপ্লব বাদী হয়ে এ মামলা করেন। তাতে বলা হয়েছে, বেকার ও গৃহিণী স্ত্রী হালিমা ৮০ লাখ টাকা ধার দিয়েছেন আমজাদ হাজারীকে। ২০০৭-০৮ কর বছরে তিনি এই টাকা দেন আমজাদকে।

জানা যায়, ২০১১ সালে আমজাদ হাজারীর অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে অভিযানে নামে দুদক। অনুসন্ধান শেষে ২০১২ সালের ২১ মার্চ আমজাদকে সম্পদ বিবরণী দাখিলের নির্দেশ দেন সংস্থাটি। ওই বছরের ১৬ এপ্রিল দুদকের কাছে সম্পদের বিবরণী দাখিল করেন আমজাদ হাজারী। তাতে তিনি ১৭ লাখ ২০ হাজার টাকার স্থাবর এবং ৭২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৮০ টাকার অস্থাবর সম্পদসহ সর্বমোট ৯০ লাখ ৭ হাজার ৪৮০ টাকার সম্পদ অর্জনের ঘোষণা দেন। তবে দুদক যাচাই বাছাই করে তার নামে সর্বমোট ৯৭ লাখ ৬ হাজার ২৪২ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য পায়, যা তিনি ২০০১ থেকে ২০১১ কর বছরে প্রদর্শন করেন। তবে দুদকের অনুসন্ধানে ওঠে আসে, আমজাদ হোসেন ২০০৭-০৮ কর বছরে তার স্ত্রী হালিমা বেগমের কাছ থেকে ৮০ লাখ টাকা ঋণ নেন। অথচ হালিমা বেগম একজন গৃহিণী। তার আয়ের কোনো বৈধ উৎস না থাকায় ঋণ দেওয়ার বিষয়টি যুক্তিসংগত ও গ্রহণযোগ্য নয়। তার কর শনাক্তকরণ নম্বর হলো ৮৬৫৯৯৪৫৬৪৯৪৩। সার্কেল-৫৮, করাঞ্চল ৩, চট্টগ্রাম।

এছাড়া হালিমা বেগম লিপি ২০২০ ও ২০২১ সালে লালখান বাজারে আলী আজগর নামের এক ব্যক্তি থেকে ১২৯৩৬ ও ২১৩০ নম্বর দলিলমূলে ৬০ লাখ টাকার জমি ও ভবন ক্রয় করেন। এ ধরনের কেনাকাটায় সাধারণত পে-অর্ডারের মাধ্যমে লেনদেন হয়ে থাকে। কিন্তু হালিমা বেগম পুরো সম্পদই কিনেছেন নগদ টাকায়। এই ৬০ লাখ টাকা স্বামীকে ইতিপূর্বে ধার দেওয়া ৮০ লাখ টাকার বাইরে। ওই ৮০ লাখ টাকা ধার দিয়েছিলেন ২০০৮ সালে।

লালখান বাজার বাঘঘোনা মসজিদের সামনের আড়াই গন্ডা জমির ক্রয় দর দেখানো হয়েছে ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা (দলিল নম্বর ৯৭৮০)। জায়গাটি সড়কের পাশেই লাগোয়া। ফলে এখানে প্রতি গন্ডা জমির দামই কোটি টাকার বেশি বলে দাবি করেছেন এলাকার লোকজন। ২০১২ সালে এই জায়গাটিও আমজাদ হাজারীর গৃহিণী স্ত্রী হালিমা বেগম লিপি কিনেছেন নগদ টাকায়।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূলত সম্পদের প্রকৃত তথ্য গোপন করতে এবং সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দিতে দলিলে কম দামে সম্পদ ক্রয় দেখানো হয়। প্রকৃতপক্ষে স্থানীয়ভাবে এই জমির বাজার মূল্য দলিলে উল্লিখিত দামের দ্বিগুণের চেয়ে বেশি। ক্রয় করা সম্পদের শ্রেণি পরিবর্তন দেখিয়ে স্থাপনাবিহীন ভূমি উল্লেখ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে সরকারের চার স্তরের কর ফাঁকির সুযোগ তৈরি হয়।

এর আগে ২০১৯ সালে ৩ কোটি ২ লাখ ৩২ হাজার ৪৮১ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আমজাদ হোসেন হাজারী ও তার স্ত্রী হালিমা বেগম লিপির বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এ মামলায় এ দম্পতি কারাবরণও করেন। পরবর্তীতে জামিনে বেরিয়ে আসেন। মামলাটি বর্তমানে তদন্তের পর্যায়ে আছে বলে জানান দুদকের কর্মকর্তারা। আমজাদ হাজারী ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে চিটাগাং ক্লাবের সদস্যপদ নেন। কিন্তু এ নিয়ে ক্লাবের ভেতরে বাইরে সমালোচনা হয়। এরপর তার সদস্যপদটি স্থগিত আছে।

আমজাদ হোসেন হাজারীর গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলা সদরের মাস্টার পাড়া হাজারী বাড়ি। তিনি ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর চাচা বলে চট্টগ্রামে পরিচিত। তিনি কাস্টমসে চাকরি করাকালীন সময়েই চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হয়ে তিনি হন লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তবে চাকরিস্থলে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মুখে তিনি লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের পদটি ছেড়ে দেন। চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-খুলশী-পাহাড়তলী-হালিশহর) অথবা ফেনী জেলার যেকোনো একটি আসন থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ারও চেষ্টা করেন।