দেশে দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা
চাকরিতে প্রবেশের বয়স নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানদণ্ড পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিশ্বের ১৬২টি দেশে সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ বছর। কোনো কোনো দেশে আবার এটি উন্মুক্ত। অথচ বাংলাদেশে বয়স ত্রিশের কোঠা পেরুলে আর সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করা যায় না। বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রায় বারো বছর ধরে আন্দোলন করে আসছে চাকরিপ্রত্যাশীরা। সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের সময়সীমা যথাক্রমে ৩৫ ও ৬৫ বছর করার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারি চাকরির বয়সসীমা নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন : শামস্ বিশ্বাস
বাংলাদেশ
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সাধারণ বয়সসীমা ৩০ বছর, যেখানে চিকিৎসক বা অন্যান্য বিশেষ ক্ষেত্রে এটি ৩২ বছর পর্যন্ত নির্ধারিত রয়েছে। সরকারি ছাড়াও আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানেও একই বয়সসীমা অনুসরণ করা হয়। আর চাকরি থেকে অবসরের সাধারণ বয়সসীমা ৫৯ বছর। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে তা ৬০ বছর। যদিও দেশের গড় আয়ু বেড়ে বর্তমানে ৭৩ বছর হয়েছে, তবুও চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা পরিবর্তিত হয়নি। বিভিন্ন বই-পুস্তকে দেখা যায়, সরকারি চাকরির বয়স নির্ধারণের বিষয়টি শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ ভারত তথা উপনিবেশিক আমল থেকে। বিভিন্ন বিষয় আমলে নিয়ে তখন চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ২৩ বছর নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরে পাকিস্তান শাসনামলে এই বয়সসীমা বাড়িয়ে ২৫ বছর করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর এই বয়স আরও দুই বছর বাড়িয়ে ২৭ বছর করা হয়। এরপর ১৯৯১ সালে এই বয়সসীমা ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয় যেটি এখনো কার্যকর রয়েছে। সে সময় বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫৭ বছর। বর্তমানে গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে ৭৩ বছর হয়েছে। এরপর বিভিন্ন সময় বয়স বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করলেও কোনো সরকারই ভ্রুক্ষেপ করেনি। সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর থেকে না বাড়ানোর বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে তৎকালীন সরকারগুলোর পক্ষ থেকে।
ভারত
ভারতে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজ্যে এবং চাকরির ধরন অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারিত রয়েছে যা ৩২-৪২ বছর পর্যন্ত। সাধারণত, ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে (আইএএস) আবেদন করতে হলে ন্যূনতম বয়স ২১ বছর এবং সর্বোচ্চ ৩২ বছর হতে হবে। তবে বিভিন্ন কোটার ক্ষেত্রে এই বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছে। যেমনÑ শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধীরা ৪২ বছর পর্যন্ত আবেদন করতে পারবেন, দলিত শ্রেণির জনগণ ৩৭ বছর এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষরা ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত আবেদন করতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৪০ বছর পর্যন্ত নির্ধারিত।
নেপাল
নেপালে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা পুরুষদের জন্য ১৮ থেকে ৩৫ বছর এবং নারীদের জন্য ৪০ বছর পর্যন্ত নির্ধারিত হয়েছে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পদে (যেমনÑ উপসচিব বা যুগ্ম সচিব) সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৪৫ বছর পর্যন্ত। তবে, নেপালের সরকারি সেবায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে (যেমনÑ স্বাস্থ্যসেবা, বিচার বিভাগ ইত্যাদি) স্থায়ী কর্মচারীদের জন্য কোনো বয়সসীমা নির্ধারিত নেই।
শ্রীলংকা
শ্রীলংকায় ২০২০ সালের আগে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ছিল ৩৫ বছর। তবে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকশে স্নাতক পাস করা বেকার চাকরি প্রার্থীদের জন্য এই বয়সসীমা ৪৫ বছর পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে, সব ধরনের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়।
পাকিস্তান
পাকিস্তানে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সাধারণ বয়সসীমা ২১ থেকে ৩০ বছর। তবে, বিশেষ কিছু কোটার ক্ষেত্রে এই সীমা ৩২ বছর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে বেলুচিস্তান প্রদেশে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বয়সসীমা ৪৩ বছর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, যা দেশের অন্য অংশের তুলনায় বেশি।
জাপান
জাপানে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা সাধারণত ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে নির্ধারিত। তবে, কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ পদের জন্য বয়সসীমা কিছুটা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ইন্দোনেশিয়া
মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর। তবে ইন্দোনেশিয়ায় এটি তুলনামূলকভাবে বেশি, যেখানে সর্বোচ্চ ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত আবেদন করা যায়।
মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ
কাতারে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর নির্ধারিত, যা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য অনেক দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে এই অঞ্চলে অনেক দেশে বয়সসীমা নিয়ে আরও নমনীয়তা রয়েছে।
ইউরোপের কয়েকটি দেশ
যুক্তরাজ্য : সরকারি চাকরিতে প্রবেশের জন্য কোনো নির্দিষ্ট সর্বাধিক বয়সসীমা নেই। প্রার্থীর ন্যূনতম বয়স সাধারণত ১৬ থেকে শুরু হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উচ্চতর পদগুলোর জন্য বয়স কোনো বাধা হিসেবে কাজ করে না। শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়।
ফ্রান্স : ফ্রান্সে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৪০ বছর। তবে উচ্চতর এবং বিশেষজ্ঞ পদের জন্য এই সীমা কিছুটা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
জার্মানি : জার্মানিতে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো সর্বাধিক বয়সসীমা নেই। তবে প্রার্থীদের সাধারণত ২৭ বছরের মধ্যে শিক্ষা সম্পন্ন করতে হয় এবং চাকরিতে যোগদানের প্রস্তুতি নিতে হয়।
আরও পড়ুন:
জলবায়ু সম্মেলনের আদ্যোপান্ত
সুইডেন : সেখানে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ ৪৭ বছর পর্যন্ত থাকে।
ইতালি : ৩৫ বছর পর্যন্ত কেউ সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে পারেন।
আমেরিকা, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া
যুক্তরাষ্ট্র : ১৮ থেকে ৫৯ বছর বয়স পর্যন্ত একজন প্রার্থী ফেডারেল সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে পারেন। তবে কিছু বিশেষ পদের জন্য বয়সসীমা নির্ধারিত।
আরও পড়ুন:
এবারের সম্মেলনে গুরুত্ব পাবে যেসব বিষয়
কানাডা : কানাডায় সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৪৭ বছর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।
অস্ট্রেলিয়া : অস্ট্রেলিয়ায় সরকারি চাকরিতে প্রবেশের জন্য ন্যূনতম বয়স ১৮ হলেও কোনো সর্বাধিক বয়সসীমা নেই।
উপসংহার
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারি চাকরির বয়সসীমা নিয়ে এই বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায়, উন্নত দেশগুলোতে বয়সসীমার বাধা তুলনামূলকভাবে শিথিল বা অনুপস্থিত। অন্যদিকে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এটি বেশ কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে প্রার্থীরা মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানালেও তা এখনও কার্যকর হয়নি।
আরও পড়ুন:
তাপমাত্রা যখন সর্বনিম্ন!