বিদেশি ঋণ বেড়ে ১০৪ বিলিয়ন ডলার
বৈদেশিক উৎস থেকে বাংলাদেশের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ আরও বেড়েছে। সর্বশেষ এপ্রিল থেকে জুনÑ এই তিন মাসেই বিদেশি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৪৫০ কোটি বা সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার। আর গত এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় পৌনে ছয় বিলিয়ন বা ৫৭০ কোটি ডলার। সব মিলিয়ে জুন শেষে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে প্রায় ১০ হাজার ৪০০ কোটি বা ১০৪ বিলিয়ন ডলার। এই ১০৪ বিলিয়নের মধ্যে বিদায়ী শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ঋণ বেড়েছে প্রায় ৮১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো শেখ হাসিনার সরকার বিদেশি উৎস থেকে দেদার ঋণ করে গেছেন। এ সময়ে সরকারি-বেসরকারি সব খাতেই বিদেশি ঋণ বেড়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় দেশে দীর্ঘদিন ধরেই ডলারের সংকট চলছে। এই সংকট সামাল দিতে বিদায়ী সরকারের আমলে আমদানি নিয়ন্ত্রণ, বিদেশি ঋণ বাড়ানোসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তার পরও রিজার্ভের পতন থামানো যায়নি। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রিজার্ভের পতন থামাতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের সময় বিদেশি ঋণের বেশির ভাগই নেওয়া হয়েছে দরকষাকষি ও বাছবিচারহীনভাবে,
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
যা সরকারের দায়দেনা পরিস্থিতিতে চাপ বাড়িয়েছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত যে মেগাপ্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত করেছে কিংবা বাস্তবায়ন করছে তার অন্যতমÑ পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল, ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর। কিন্তু এসব করতে গিয়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। দুঃখজনক হলোÑ এসব ঋণের অর্থে চলমান প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন যখন সম্পন্ন হবে, তখন প্রকল্পগুলোর আয় থেকে ঋণের কিস্তির অতিসামান্য অংশই পরিশোধ করা সম্ভব হবে।
গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত জুন পর্যন্ত বিদেশি ঋণের প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, গত জুন শেষে বৈদেশিক মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩৭৮ কোটি ডলার বা ১০৩ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন, যা দেশীয় মুদ্রায় দাঁড়ায় ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৩৬০ কোটি টাকার সমান (প্রতি ডলার ১২০ টাকা ধরে। এর মধ্যে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৩ দশমিক ২১৫ বিলিয়ন ডলার। আর দেশের বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২০ দশমিক ৫৭৪ বিলিয়ন ডলার। অথচ বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার বিদায় নেয়ার পর (২০০৬ সাল শেষে) বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ বিলিয়ন ডলারের কিছু কম। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে তা সোয়া দুই বিলিয়ন ডলারের মতো বাড়ে। এতে ২০০৮ সাল শেষে তা দাঁড়ায় ২১ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। তবে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে তা বেড়ে ৮২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০০৮ সাল শেষে সরকারের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ২১ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দায়িত্ব নেয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। পরের পাঁচ বছরে সরকারের বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পায় ৬ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। এতে ২০১৩ সাল শেষে সরকারের বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ২৭ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। ওই পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৯ সালে সরকারের বিদেশি ঋণ ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন বাড়লেও ২০১০ সালে তা প্রায় ৬৭৫ মিলিয়ন ডলার হ্রাস পায়। তবে পরের বছর তা প্রায় ৭২৯ মিলিয়ন ডলার বাড়ে। যদিও ২০১২ সালে বাড়ে প্রায় ১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ও ২০১৩ সালে প্রায় ৩ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার।
২০১৪ সালে আবারও ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। এর পরের পাঁচ বছরে (২০১৪-২০১৮ সাল) দ্রুত বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পায়। ওই পাঁচ বছরে সরকারের বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পায় ১৬ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার বা ৬০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সাল শেষে সরকারের বিদেশি ঋণস্থিতি দাঁড়ায় ৪৪ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। ওই পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৪ সালেই বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পায় ২ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। তবে পরের বছর তা মাত্র ৩১ মিলিয়ন ডলার বাড়ে। ২০১৬ সালে বিদেশি ঋণ বাড়ে ১ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার, ২০১৭ সালে রেকর্ড ৬ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ও ২০১৮ সালে ৫ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের পাঁচ বছরে (২০১৯-২০২৩) বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ সময় বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৩৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৭৯ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭৯ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। এ পাঁচ বছরের মধ্যে ২০১৯ সালে বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে বৃদ্ধি পেয়েছে ৮ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০২১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়েছে ৯ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ২০২২ সালে সরকারের বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৪ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার ও ২০২৩ সালে বেড়েছে সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার, যা তৃতীয় সর্বোচ্চ।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
চতুর্থ মেয়াদের ছয় মাসে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ৩ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। আওয়ামী লীগ চলতি বছরের জানুয়ারিতে চতুর্থবারের মতো পাঁচ বছরের জন্য সরকার গঠন করে। তবে ছয় মাসের মাথায় গণ-আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশে থেকে পালিয়ে যান। এই সরকারের পতনের আগে জুন পর্যন্ত বিদেশি ঋণ রেখে যান ১০৩ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার।