দেশে দেশে যত আকস্মিক বন্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
দেশে দেশে যত আকস্মিক বন্যা

সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী দেখা দিয়েছে নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এরই ফলে বিভিন্ন দেশে দেখা যাচ্ছে বন্যা। এ বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আকস্মিক বন্যায় প্রাণ হারিয়েছে অসংখ্য মানুষ। গত জুলাই থেকে যেসব দেশে চলছে আকস্মিক বন্যা সেসব দেশ নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন। ইন্টারনেট থেকে তথ্য নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন -আজহারুল ইসলাম অভি

চীন

জুলাই মাসে মধ্য চীনে বাঁধ ভেঙে বন্যার সৃষ্টি হয়েছিল। গত ৫ জুলাই বিকালে মধ্য চীনের হুনান প্রদেশের ডংটিং হ্রদের তীরে একটি বাঁধের অংশ ভেঙে পড়ে। এ ঘটনায় তখন তাৎক্ষণিকভাবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া না গেলেও প্রায় ছয় হাজার স্থানীয় লোকজন কাছাকাছি এলাকা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে। এই বন্যায় বাঁধ ভেঙে কৃষি জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে এবং গ্রামের কিছু বাড়িও ডুবে গেছে। দেশটির রোড মনিটরিং সেন্টারের মতে কাউন্টিতে প্রায় অর্ধ মিলিয়ন মানুষের বসবাস। বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সেখানে সব রাস্তায় সতর্কতা জারি করেছিল দেশটি। এই ভয়াবহ বন্যায় দেশটির জরুরি ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ৮০০ জনেরও বেশি মানুষ, প্রায় ১৫০টি যানবাহন সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়। শুধু তাই নয়, দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার হুনান এবং অন্যান্য দুর্যোগকবলিত এলাকার ত্রাণ তহবিলের জন্য অতিরিক্ত ৫৪০ মিলিয়ন ইউয়ান (২৪ মিলিয়ন ডলার) বরাদ্দ করেছে বলে অর্থ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে সিসিটিভির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে আবহাওয়া এমন রূপ ধারণ করেছে। এ ছাড়া হুনান-এর আগের মাসে মারাত্মক পাহাড়ি বন্যা এবং ভূমিধসের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। অন্যদিকে দক্ষিণ গুয়াংডং প্রদেশে বন্যায় একই সময়ে ৩৮ জন নিহত হয়েছে।

ভারত

লাগাতার বৃষ্টিতে গত জুলাই মাসে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল ভারতে। দেশটির উত্তর প্রদেশ ও হিমাচল প্রদেশে দুই সপ্তাহের বন্যায় কমপক্ষে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। জানা যায়, ভারতের উত্তর প্রদেশের ১২টি জেলার ৬০০-র বেশি গ্রাম পানিমগ্ন ছিল। অন্যদিকে বর্ষার মৌসুম শুরু হতে না হতেই চরম ভোগান্তি শুরু হয়েছে হিমাচল প্রদেশেও। বৃষ্টিজনিত কারণে এই রাজ্যে জুলাইয়ে ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আটজন পানিতে ডুবে, ছয়জন উপর থেকে নিচে পড়ে, চারজন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এবং তিনজন সাপের কামড়ে প্রাণ হারিয়েছেন। বন্যাকবলিত এলাকায় মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭২ কোটি রুপি। প্রবল বর্ষণের জেরে ধস নেমে মান্ডি ও সিমলার বহু রাস্তা বন্ধ। এ পরিস্থিতিতে শতাধিক ট্রেনের শিডিউল বাতিল করেছিল রেল প্রশাসন। তেলেঙ্গনা রাজ্যের আবিলাবাদ, নিজামাবাদসহ বিভিন্ন স্থানে জারি করা হয়েছে রেড অ্যালার্ট। এখনো ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে চলছে বন্যা। বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়াসহ ব্যাহত হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থাও।

পাকিস্তান

জুলাই মাসে শুরু হওয়া ভারী বৃষ্টি ও আকস্মিক বন্যায় পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ১৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছেন অন্তত ৩৩৩ জন। পাকিস্তানের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের (এনডিএমএ) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৯৬ জন শিশু ও ৩০ জন নারী। এনডিএমএর প্রতিবেদনে বলা হয়, বন্যায় দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় পাঞ্জাব প্রদেশে ৬৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় খাইবার পাখতুনখোয়া এবং দক্ষিণ সিন্ধু প্রদেশে যথাক্রমে ৬৫ ও ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বেলুচিস্তান প্রদেশে ১৩ জন, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে পাঁচজন এবং উত্তরাঞ্চলীয় গিলগিট-বালতিস্তান অঞ্চলে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় ৩৫২টি গবাদিপশু মারা গেছে। এ ছাড়া বন্যায় ২ হাজার ২৯৩টি বাড়ি ও ৩০টি সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও উল্লেখ করেছে এনডিএমএ।

দুবাই

এ বছর স্মরণকালের রেকর্ড বৃষ্টিপাতে নজিরবিহীন বন্যা দেখা গেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) দুবাই শহরে। বন্যায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বিশ্বের দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। গত এপ্রিলে ২৪ ঘণ্টার অস্বাভাবিক এক বৃষ্টিতে এমন রেকর্ড বন্যার পর কৃত্রিমভাবে বৃষ্টি নামানো নিয়ে গুঞ্জন উঠেছে। এর আগে এমন ঘটনা ঘটেছে কিনা, মনে করতে পারছে না দুবাই। আচমকাই মরু শহরে শুরু হয় বৃষ্টি। সমুদ্রের পানি ঢুকে পড়ে শহরের ভেতর। ভেসে যায় গাড়ি। রাস্তাঘাটে থইথই করছে পানি। কার্যত স্তব্ধ হয়ে যায় দুবাই। বন্ধ করে দিতে হয় বিমানবন্দর। অসংখ্য ফ্লাইট বাতিল ও বিলম্বিত হওয়ায় দুবাই বিমানবন্দরে অনেক মানুষকে রাত কাটাতে হয়। আবুধাবি প্রদেশের আল আইন শহরে সর্বোচ্চ ২৫৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা গত ৭৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ১৯৪৯ সালে জাতীয় আবহাওয়া কেন্দ্র স্থাপিত হওয়ার পর এটাই সর্বোচ্চ নথিভুক্ত বৃষ্টিপাত। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দুই দিনে সেখানে প্রায় এক হাজার ৪৪টি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। ৪১টি ফ্লাইট ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে উড়োজাহাজগুলো অবতরণ করতে পেরেছে, সেগুলোর পাইলটরা জানিয়েছেন, রানওয়ের ওপরেও পানি ছিল।

বাংলাদেশ

বাংলাদেশে স্মরণকালের নজিরবিহীন বন্যায় দেশের ১১ জেলার ৫০ লাখ মানুষ পানিবন্দি ও ক্ষতির মুখে পড়েছেন বলছে সরকারের তথ্য। মারা গেছেন ১৮ জন। আর ব্র্যাকের হিসাব বলছে এই বন্যায় এখন পর্যন্ত ৮০ লাখ মানুষ ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ৪৫ লাখ মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। এদিকে পানি বেড়ে যাওয়ায় কাপ্তাই লেকের গেটও খুলে দেওয়া হয়েছিল। তাতে চট্টগ্রামের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। খুলনায় বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় সেখানেও কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে।


নেপাল

নেপালে ভারী বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যা ও ভূমিধসে অন্তত ১১ জন নিহত হয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন আরও ১২ জন। ৮ জন ছিলেন নিখোঁজ। ৭ জুলাই নেপালি কর্মকর্তারা এই তথ্য জানিয়েছিলেন। বন্যায় প্রধান মহাসড়কসহ অন্যান্য সড়ক যোগাযোগ ছিল বন্ধ। পুলিশ মুখপাত্র দান বাহাদুর কারকি জানিয়েছিলেন, আশঙ্কা করা হচ্ছে, নিখোঁজ ব্যক্তিরা হয় বন্যার পানিতে ভেসে গেছেন বা ভূমিধসে চাপা পড়েছেন। আহতদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সুনসারি জেলার সিনিয়র কর্মকর্তা বেদ রাজ ফুয়াল জানিয়েছেন, নেপালের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় কোশি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। নদীটি প্রায় প্রতি বছরই পূর্ব ভারতের বিহার রাজ্যে বিধ্বংসী বন্যা ঘটায়। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পানি নিষ্কাশনের জন্য কোশি ব্যারেজের ৫৬টি গেটই খুলে দেওয়া হয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় ব্রারেজটির মাত্র ১০-১২টি গেট খুলে দেওয়া হয়। পাহাড় ঘেরা কাঠমান্ডুর বেশ কয়েকটি নদীর পানি বেড়ে সড়ক ও অনেক বাড়ি-ঘর প্লাবিত হয়েছে। বাসিন্দারা ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাওয়ার জন্য বালতি ব্যবহার করছেন। জুনের মাঝামাঝি সময় থেকে নেপালে ভূমিধস, বন্যা এবং বজ্রপাতে অন্তত ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে পার্বত্য নেপালের বেশিরভাগ অঞ্চলেই ভূমিধস ও আকস্মিক বন্যায় প্রতি বছর শত শত মানুষ মারা যায়। দেশটিতে বর্ষা মৌসুম সাধারণত জুনের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়ে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলতে থাকে।

মিয়ানমার

সংঘাত-বিধ্বস্ত মিয়ানমারে আকস্মিক বন্যায় বিভিন্ন অঞ্চল প্লাবিত ও প্রায় আড়াই লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিদেশি সাহায্যের আহ্বান জানিয়েছে জান্তা সরকার। রাষ্ট্রীয় মিডিয়ার বরাত দিয়ে শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে দ্য স্টার। প্রতিবেদনে বলা হয়, টাইফুন ইয়াগির প্রভাবে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে সৃষ্ট বন্যায় বিপর্যস্ত মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চল। ভয়াবহ এই বন্যায় অন্তত ৩৩ জন নিহত হয়েছে। এছাড়া ৫৯ হাজার ৪১৩টি পরিবারের ২ লাখ ৩৬ হাজার ৬৪৯ জন বন্যার কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমারের খবর অনুসারে, জান্তা সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইং গত শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) এক বৈঠকে সরকারি কর্মকর্তাদেরকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধার ও ত্রাণ সহায়তা পেতে বিদেশি দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করার নির্দেশ দিয়েছেন। জান্তার মুখপাত্র জাও মিন তুন এক অডিও বিবৃতিতে বলেছেন, কিছু এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং রোববার পর্যন্ত সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। মধ্য মান্দালয় অঞ্চলে একটি সোনার খনির এলাকায় কয়েক ডজন অভিবাসী শ্রমিক ভূমিধসের পর নিখোঁজ হওয়ার খবর কর্তৃপক্ষ তদন্ত করছে। জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে এর আগে বিদেশ থেকে আসা মানবিক সহায়তায় বাধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। গত বছর দেশটির পশ্চিমে আঘাত হানা একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ লাখ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টাকারী সহায়তা গোষ্ঠীগুলোর ভ্রমণ অনুমোদন স্থগিত করেছিল জান্তা সরকার। জাতিসংঘ এই সিদ্ধান্তকে ‘অকল্পনীয়’ বলে নিন্দা জানিয়েছিল।

কানাডা

রেকর্ড বৃষ্টিপাতে আকস্মিক বন্যায় তলিয়ে গিয়েছিল কানাডার টরন্টোর বিস্তীর্ণ এলাকা। স্থবির হয়ে পড়েছিল সড়ক, রেল ও বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থা। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে দুর্ভোগে পড়েছিলেন প্রায় দুই লাখ মানুষ। পরপর তিনটি প্রবল বজ্রঝড় ও তুমুল বৃষ্টিপাতের তোড়ে আকস্মিক জলাবদ্ধতায় স্থবির হয়ে পড়েছিল কানাডার সবচেয়ে বড় শহর টরন্টো। আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছিল, মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) বৃষ্টিপাত হয়েছে প্রায় একশ মিলিমিটার। ১৯৪১ সালের পর এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতি আর দেখেনি কানাডাবাসী। ডন নদী তীরবর্তী সড়ক ডুবে ইঞ্জিনে পানি ঢুকে অনেক যানবাহন আটকা পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে অন্তত ১৪ জনকে উদ্ধার করেছিল ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হয়ে ভোগান্তিতে পড়েন কমপক্ষে এক লাখ ৬৭ হাজারের বেশি গ্রাহক। বিদ্যুৎ না থাকায় অনেকে লিফটে আটকা পড়ে উদ্ধারের আকুতি জানিয়ে ফোন দেন ফায়ার সার্ভিসে। পানি ঢুকেছে বাসাবাড়ি আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। পানির ঢল ঢুকেছিল রেল স্টেশন আর পাতাল সড়কে। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় বিলি বিশপ বিমানবন্দরে ফ্লাইটের ওঠানামায় বিরূপ প্রভাব পড়ে। কিছু ফ্লাইট বাতিল আর বেশ কিছু ফ্লাইটের সময়সূচি পিছিয়েও দেওয়া হয়েছিল।