ক্রেতা ধরে রাখতে বিশেষ উদ্যোগ ব্যবসায়ীদের
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তৈরি পোশাকশিল্পে চলমান অস্থিরতায় বিদেশি ক্রেতা হারানোর শঙ্কায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। সাভার, আশুলিয়ায় প্রায় ১৫ দিন ধরে শ্রমিক অসন্তোষে চলা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের কারণে কারখানাগুলো বন্ধ ছিল। এতে একদিকে উৎপাদন বন্ধ ছিল, অন্যদিকে উৎপাদনকৃত পণ্য ক্রেতাদের বেঁধে দেওয়া সময়ে জাহাজীকরণ করা যায়নি; ক্রেতা দেশগুলোতে সময়মতো পণ্য পৌঁছানো যায়নি। ফলে ক্রেতাদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এমনকি এই অস্থিরতার মধ্যে আমেরিকাসহ ইউরোপের পাঁচটি দেশ বাংলাদেশে ভিজিট বন্ধ করেছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, ক্রেতারা আসতে না পারায় অর্ডার কমে গেছে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশনও (বিজিবিএ) অস্থিরতায় অর্ডার কমার শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, প্রতিনিয়ত ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে, তাদের পুরো বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ক্রেতাদের ধরে রাখতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এরই ধারাবাহিকতায় আগামীকাল বা এর পরের দিন বিদেশি ক্রেতাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বৈঠকে বসবে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সারা পৃথিবীর মানুষ চেনে। তার ইমেজ কাজে লাগাতে পারলে এই সংকট কেটে যাবে বলেও তারা আশা করছেন। তারা বলেছেন, ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে যে সমস্যা ছিল, তাও কেটে যাবে এবং বাজারের পরিধি আরো বাড়বে। এ ছাড়া কারখানা চালু রাখতে সরকারের কাছে সর্বোচ্চ সহযোগিতা চেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরো শক্তিশালী করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তারা। সরকার নিরাপত্তা দিতে পারলে এবং কারখানাগুলো পুরোদমে উৎপাদনে গেলে গত ১৫ দিনের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে সরকার, শ্রমিক ও মালিকপক্ষ দফায় দফায় বৈঠক করার পর গতকাল রবিবার গাজীপুর এলাকার তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত ৮৭৬টি পোশাক কারখানা চালু ছিল। আর সাভার, আশুলিয়া ও জিরানী এলাকায় ৪০৭টি চালু হলেও ১৬টি পোশাক কারখানা বন্ধ ছিল। তবে শিগগিরই কাজের পরিবেশ ফিরে আসবে বলে আশা করছেন মালিক ও শ্রমিক পক্ষ- এমন তথ্য জানান বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল।
এদিকে ব্যবসায়িক সুবিধা নিতে মালিকদের চাপে রাখতে শ্রমিকদের মধ্যে বহিরাগতরাও ঢুকে পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, শ্রমিক অসন্তোষ পুঁজি করে কারখানাগুলোর ঝুঁট ব্যবসা, খাদ্যসামগ্রী সাপ্লাইসহ অন্যান্য ব্যবসা বাগিয়ে নিতে তৎপর প্রভাবশালী একটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। নেপথ্য থেকে তাদের মদদ দিচ্ছেন প্রভাবশালী এক কেন্দ্রীয় নেতা এবং জেলা পর্যায়ের এক নেতা। মূলত তারাই কলকাঠি নাড়ছেন।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পথে। সব কারখানা চালু হলেই আগামীকাল-পরশুর মধ্যে বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে। আশা করা যায় ক্রেতারা আমাদের সমস্যার কথা শুনবেন এবং স্বাভাবিকভাবে অর্ডার দেওয়া শুরু করবেন।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিবিএ) সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, এই সংকটের সময়ে অর্ডার যাতে বাতিল না করে, সেজন্য প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করা হচ্ছে। আশা করি ক্রেতারা আমাদের কথা শুনবেন।
বিজিবিএর সাবেক সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসেন বলেন, এমন সংকট উত্তরণের জন্য প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ইমেজ কাজে লাগাতে হবে। তিনি অনুরোধ করলে কোনো ক্রেতা মুখ ফেরাবে না।
সাভার থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জাহিদুর রহমান জানান, শিল্পাঞ্চলে চলমান পরিস্থিতি পর্যালোচনায় আশুলিয়ার বিভিন্ন তৈরি পোশাক কারখানা পরিদর্শন করছেন কর্মকর্তারা। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. সবুর হোসেনের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের কমিটি তৈরি পোশাক কারখানার মালিক শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
বৃষ্টি ও তীব্র যানজটের মধ্যেই খুলে দেয়া বিভিন্ন কারখানায় কাজে যোগ দেন শ্রমিকরা। শিল্পাঞ্চল ঘিরে বাড়ানো হয় যৌথবাহিনীর সমন্বয়ে পুলিশ, আর্মড পুলিশ, বিজিবি ও সেনা সদস্যদের তৎপরতা। পাশাপাশি শিল্পাঞ্চল অস্থিতিশীলতার নেপথ্যে থাকা ইন্ধনদাতাদের বিষয়েও বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন কারখানার সামনে মোতায়েন করা হয়েছে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান, র্যাব, পুলিশের রায়ট কার ও জলকামান। প্রস্তুত রাখা হয় সেনাবাহিনীর কুইক রি-অ্যাকশন ফোর্স। বিশৃঙ্খলাকারীদের তাৎক্ষণিকভাবে শাস্তি নিশ্চিত করা হয় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতি।
তবে কারখানায় দাবি-দাওয়া নিয়ে কোনো অস্থিরতা তৈরি হলে সোমবার (আজ) থেকে ফের অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ রাখা হবে এবং যেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। সেখানে কাজ নেই, বেতন নেই; এই আইন অনুসরণ করা হবে বলে জানিয়েছে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।
তাদের এ সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)। বিজিএমইএর সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম জানান, পরিস্থিতি আগের চাইতে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। মালিক ও শ্রমিকদের যৌথভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, কোথায় কিছু বিষয়ে দ্বিমত বা দাবি দাওয়া থাকলে সেটা মীমাংসার বিকল্প নেই।
গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, টানা দুই সপ্তাহের শ্রমিক বিক্ষোভের মধ্যে এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসছে গাজীপুরের শিল্পকারখানার পরিবেশ। গতকাল জেলার কোথাও বিক্ষোভের খবর পাওয়া যায়নি। এদিকে বিভিন্ন দাবিতে চলা শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে গাজীপুরে টানা পাঁচ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে আটটি কারখানা। এর আগে অনির্দিষ্টকালের জন্য এগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। কারখানাগুলোর উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এতে শ্রমিকদের চলতি মাসের বেতন, কারখানার খরচসহ আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে কারখানার মালিকরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারওয়ার আলম বলেন, ‘বন্ধ থাকা কারখানাগুলোর মালিকরা বিজিএমইএর সঙ্গে মিটিং করছেন। শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলেই কারখানাগুলো পুনরায় চালু হবে। আমরা তাদের সব রকম সহযোগিতায় প্রস্তুত আছি। তিনি আরো বলেন, আজ (গতকাল) জেলায় কোনো শ্রমিক অসন্তোষের খবর পাওয়া যায়নি। পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে আসছে অনেকটা।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর গাজীপুর জেলা কার্যালয়ের তথ্য মতে, পুরো জেলায় সব মিলিয়ে নিবন্ধিত কারখানা রয়েছে ২ হাজার ৬৩৩টি। এর বাইরে অনিবন্ধিত কারখানা আছে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০টি। এসব কারখানায় প্রায় ২২ লাখ শ্রমিক কাজ করেন।