ঢাকা ওয়াসায় অস্থিরতা কলকাঠি নাড়ছে কে

শাহজাহান মোল্লা
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ঢাকা ওয়াসায় অস্থিরতা কলকাঠি নাড়ছে কে

হাসিনা সরকারের পতনের পর ভেঙে পড়ে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের সাম্রাজ্য। তাকসিম গেলেও এখনও ঢাকা ওয়াসায় অস্থিরতা বিরাজ করছে। ফলে ঝিমিয়ে পড়েছে সেবা কার্যক্রম। বিদেশি ফান্ডে পরিচালিত অনেক প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় পড়েছে। যেসব কাজ চলমান ছিল সেগুলো নিয়েও সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছেন ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাকসিম এ খান বিদায়ের পর এমডি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় সংস্থারই উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ওএন্ডএম) প্রকৌশলী একেএম সহিদ উদ্দিনকে। তবে তার নিয়োগে শুরু থেকেই আপত্তি তুলেছিলেন ঢাকা ওয়াসারা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। শেষ পর্যন্ত তার নিয়োগের বিষয়টি আদালতে গড়ায়। আদালতের নির্দেশে তার নিয়োগও অবৈধ ঘোষণা করে কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে। এর মধ্য দিয়ে ঢাকা ওয়াসার এমডি পদটি বর্তমানে শূন্য রয়েছে। সংস্থার শীর্ষ পদে এমন টানাপড়েনে পুরো ঢাকা ওয়াসাতেই অস্থিরতা চলছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সেবা ও উন্নয়ন কার্যক্রমে।

ঢাকা ওয়াসায় এমন অস্থিরতার পেছনে এখনো সাবেক এমডি তাকসিম এ খানের হাত রয়েছে বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। তাদের মতে, তাকসিম চলে গেলেও তার অনুসারীরা আছেন বহাল তবিয়তে। তারা চেষ্টা করছেন তাকসিমকে এমডি পদে একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে এবং এ জন্য যা যা করার তারা তা করবেন। কয়েক দিনের জন্য নিয়োগ পাওয়া একেএম সহিদ উদ্দিন নিজেও তাকসিমের সময়ে আশীর্বাদপুষ্ট কর্মকর্তা ছিলেন। কেননা এই সহিদ উদ্দিন ২০১৬ সালে প্রধান প্রকৌশলী পদ থেকে অবসরে চলে যান। এরপর পরামর্শক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০১৮ সালের এপ্রিলে তাকে দুই বছরের চুক্তিতে পরিচালক (কারিগরি) হিসেবে নিয়োগ দেন তৎকালীন এমডি তাকসিম এ খান। তার এই নিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল।

এসব বিষয়ে কথা বলতে সহিদ উদ্দিনের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না।

ঢাকা মহানগরী ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত ঢাকা ওয়াসার পরিষেবা। বিস্তীর্ণ এই এলাকার মানুষের পানি সরবরাহ ও পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে থাকে ঢাকা ওয়াসা। পানির দৈনিক চাহিদার বিপরীতে উৎপাদনে সক্ষমতা দেখালেও ওয়াসার পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম অত্যন্ত নাজুক। গত ১৫ বছরের অধিক সময় ধরে ওয়াসা পরিচালিত হয়েছে তাকসিম এ খানের কথায়। তিনি এতটাই ক্ষমতাবান ছিলেন যে দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতাসহ নানা অভিযোগ উঠলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের দোহাই দিয়ে একের পর এক চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করেছেন। ওয়াসায় তার বিরুদ্ধে কথা বলার মানুষ একটিও ছিল না। যখন যিনি কথা বলার চেষ্টা করেছেন তাকেই বরখাস্ত অথবা চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। দীর্ঘদিন এক পদে থাকায় পছন্দমতো কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে নিজের একটি বলয় তৈরি করে গেছেন তাকসিম। তাই নিজে পদে না থাকলেও এখনও তার ছায়া ওয়াসাতে রয়েই গেছে বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ জন্য ওয়াসায় অস্থিরতা বিরাজ করছে বলে জানান অনেকে।

গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর গা-ঢাকা দিয়ে ছিলেন তাকসিম। ১৫ আগস্ট তাকে বরখাস্ত করে সরকার। সেদিন সরকার তার চুক্তির পরবর্তী মেয়াদকাল বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। সেই প্রজ্ঞাপনেই উল্লেখ ছিল, ঢাকা ওয়াসা বোর্ড পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন-১৯৯৬ এর ৬ ধারা অনুযায়ী একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের কার্যক্রম গ্রহণ করবে। তবে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব পালন করবেন ঢাকা ওয়াসায় কর্মরত জ্যেষ্ঠতম উপব্যবস্থাপনা পরিচালক।

আইনের এই ধারায় ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে এমডির দায়িত্ব নেন একেএম সহিদ উদ্দিন। এখানেও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। ঢাকা ওয়াসায় ডিএমডি পদে মোট ৪ জন কর্মরত। সহিদ উদ্দিন ছাড়া অন্য তিনজন হলেন সৈয়দ গোলাম মোহাম্মদ ইয়াজদানি, মো. আক্তারুজ্জামান ও মিজানুর রহমান। তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ডিএমডি ইয়াজদানি। তাকসিম খানের রোষানলে পড়ে বরখাস্ত হয়ে উচ্চ আদালতে যান তিনি। ১০ জুন বরখাস্তের সিদ্ধান্ত অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এরপর আদালতের রায় নিয়ে ঘুরলেও তিনি কাজে যোগদান করতে পারেননি। এদিকে আক্তারুজ্জামানকে ডিএমডি পদে নিয়োগ দেওয়া হয় ২০২২ সালের ১০ মে। চার মাস পর একই বছরের ৭ সেপ্টেম্বর নিয়োগ পান বাকি দুই ডিএমডি সহিদ উদ্দিন ও মিজানুর রহমান। তাই এখানে জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘন প্রমাণিত হয়। তবে ঢাকা ওয়াসায় যেহেতু প্রকৌশলগত কাজ বেশি, সেক্ষেত্রে এমডি হিসেবে একজন প্রকৌশলীকেই বেছে নেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। সেদিক থেকে সহিদ উদ্দিন জ্যেষ্ঠ।

পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন-১৯৯৬ এর ৬ ধারা মোতাবেক ওয়াসার এমডি নিয়োগ দেওয়ার কথা। সেই আইনে বলা আছে ঢাকা ওয়াসায় ১১ সদস্যের একটি বোর্ড থাকবে। সেই বোর্ডে এমডি একজন সদস্য। বোর্ড এমডি পদের চাহিদা চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেবে, মন্ত্রণালয় উপযুক্ত ব্যক্তিকে নিয়োগ দেবে। তবে নতুন এমডি নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত উপব্যবস্থাপনা পরিচালকদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তি দায়িত্ব পালন করবেন।

এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফা আমাদের সময়কে বলেন, ঢাকা ওয়াসার এমডি নিয়োগ হয় বোর্ডের সিদ্ধান্তে। সেই পদ্ধতি অনুসরণ না করে অবৈধভাবে এমডির চেয়ার দখল করা সহিদ উদ্দিনকে অপসারণ করেছে মন্ত্রণালয়। এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই; কারণ সহিদ উদ্দিন তাকসিমের আশীর্বাদপুষ্ট। তবে এখন ঢাকা ওয়াসা অ্যাক্ট ১৯৯৬ বাতিল করে সকল ওয়াসাকে মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার সময় হয়েছে। তা নাহলে আবার তাকসিমের মতো মাফিয়ার আগমন ঘটবে।

ঢাকা ওয়াসা শ্রমিক ইউনিয়ন (সিবিএ) সভাপতি আনিসুজ্জামান খান শাহীন আমাদের সময়কে বলেন, সাবেক এমডি তাকসিম চলে গেলেও তার প্রেতাত্মারা এখনো বহাল তবিয়তে। তারাই মূলত ওয়াসাকে অস্থির করে তুলছে। গত ১৫ বছরে তাকসিম এ খান নিজের পছন্দমতো লোক নিয়োগ দিয়েছে। যারা দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রতিবাদ করেছে তাদেরকেই চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এমনকি ওয়াসার চেয়ারম্যানকেও বরখাস্ত করেছেন তাকসিম।