রাষ্ট্রীয় অবদানের দোহাইয়ে প্লট পান ১৫ ড্রাইভার
রাষ্ট্রীয় বিশেষ অবদানের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিপ্রায় অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত ১৫ গাড়িচালককে দেওয়া হয়েছে সরকারি প্লট। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্লট বরাদ্দ নীতিমালার ১৩/এ ধারা মোতাবেক এসব প্লট দেওয়া হয়েছে, যা নীতিমালায় বর্ণিত ক্যাটাগরির সাথে সাংঘর্ষিক।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, রাজউকের গত ৪/২৪তম বোর্ডসভায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ১৫ গাড়িচালকের নামে প্লট বরাদ্দ চূড়ান্ত করে সংস্থাটি। যদিও প্লটগুলো এখনও চূড়ান্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। নীতিমালা অনুযায়ী প্রথম কিস্তির টাকা পরিশোধের পর তাদের নামে সাময়িক বরাদ্দ দেওয়া হয়। তাদের বরাদ্দ দেওয়া হয় রাজউকের পুরনো বিধিমালা (১৩/ক ধারা) অনুযায়ী। পরবর্তীকালে সেই বিধিমালা সংশোধন হলেও ১৩/ক ধারার শর্তগুলো ধারা-৭ এ সন্নিবেশ করা হয়।
সরকারি প্লট-ফ্ল্যাট বরাদ্দ সংক্রান্ত সর্বশেষ বিধিমালা চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল প্রণীত হয়। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট-১৯৫৩ এর অধীনে প্রণীত বিধিমালা ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ভূমি, প্লট, স্পেস ও ফ্ল্যাট বরাদ্দ) বিধিমালা-২০২৪’ অনুযায়ী প্লট-ফ্ল্যাট বরাদ্দ সংক্রান্ত বিষয়ে বলা হয়েছে- এই বিধিমালায় অন্যান্য যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কর্তৃপক্ষ জনস্বার্থে নিম্নবর্ণিত ব্যক্তিকে সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে আবাসিক প্লট বরাদ্দ প্রদান করতে পারবে। সেখানে যেসব ক্যাটাগরিতে প্লট
বরাদ্দের কথা রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে- (ক) মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী বা সমমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি, (খ) সংসদ সদস্য, (গ) বীর মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ পরিবারের সরাসরি সদস্য এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মে বা কর্তৃপক্ষের আইন প্রণয়নবিষয়ক কাজে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখিয়াছেন এইরূপ সরকারি কর্মচারী অথবা এমন কোনো পেশাজীবী যিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত না থাকিলেও যাহার কর্মকা- দ্বারা জনসেবা বা জনকল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বা করিয়াছেন অথবা এমন কোনো ব্যক্তি যিনি জনগণ বা রাষ্ট্রের কল্যাণে বিশেষ অবদান রাখিয়াছেন অথবা নিবেদিত প্রাণ কোনো সমাজকর্মী বা সমাজসেবক।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গাড়ি চালকরা যেহেতু বর্ণিত কোনো ক্যাটাগরিতেই প্লট পাওয়ার যোগ্য নন, তাই রাজউকের নথি বলছে- সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গাড়িচালকদের ‘রাষ্ট্রের কল্যাণে বিশেষ অবদান রাখিয়াছেন’ মর্মে প্লটগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
গত ৩০ জানুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ মনিরা বেগম স্বাক্ষরিত একটি চিঠি রাজউকে পাঠানো হয়। ওই চিঠির আলোকে রাজউক প্লট বরাদ্দ দেয়। সেই চিঠিতে উল্লেখ ছিল- প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত ১৫ জন গাড়িচালকের অনুকূলে প্লট বরাদ্দের জন্য অনুরোধ। এতে বলা হয়- প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত নিম্নবর্ণিত ১৫ জন গাড়ি চালক কর্তৃক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাজউকের আওতাধীন ঝিলমিল প্রকল্পে প্রতি দুইজন আবেদনকারীর অনুকূলে একটি করে ৩ কাঠার প্লট এবং ৩ জন আবেদনকারীর অনুকূলে একটি করে ৫ কাঠার প্লট বরাদ্দ প্রদানের বিষয়ে সদয় সম্মতি প্রদান করেছেন।
এসব প্লট বরাদ্দ সংক্রান্ত বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. ছিদ্দিকুর রহমান সরকার (অব.) আমাদের সময়কে বলেন, প্লট বরাদ্দ নিয়ে রাজউকের নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত নেই। যখন যিনি প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বা সম মর্যাদার পদে থাকেন, তখন তিনি লিখিতভাবে রাজউকের কাছে বরাদ্দের জন্য চিঠি পাঠান। রাজউক শুধু সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় অনুযায়ী ১৫ জন গাড়িচালককে প্লট দেওয়া হয়েছে। এখন যদি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মনে করে বাতিল করবে, সেটাও করতে পারেন। সরকার যেভাবে নির্দেশনা দেবে, রাজউক বোর্ড সভায় সেভাবেই নির্দেশনাগুলো অনুমোদন লাভ করবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, রাজউকের প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে। দেশের আরো গাড়িচালক রয়েছেন; তারা কি এই সুবিধা পেয়েছে? তাহলে তারা কোন ক্যাটাগরিতে প্লট পান? ক্ষমতার অপব্যহারের জন্য যারা দায়ী তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। শুধু সাবেক প্রধানমন্ত্রী না, তার কার্যালয়ে যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, তাদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। যারা সুযোগটা নিয়েছেন, তারাও নৈতিকতার দিক থেকে সঠিক কাজ করেননি। আর রাজউক যেহেতু প্লটের মালিক, তারা কেন এসব প্লট বরাদ্দের আগে বলতে পারেনি এটা আইনসিদ্ধ নয়। কাজেই রাজউকও দায় এড়াতে পারে না। প্লট বাতিলের পাশাপাশি দায়িত্বে অবহেলার জন্য সবাইকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে।
যেসব গাড়িচালকের নামে প্লট বরাদ্দ হয়েছে
মো. সাইফুল ইসলাম ভিভিআইপি গাড়িচালক, মো. সফিকুল ইসলাম ভিভিআইপি গাড়িচালক, মো. নুরুল ইসলাম ভিভিআইপি অ্যাম্বুলেন্স চালক, মো. রাজন মাদবর প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের গাড়িচালক, মো. মাহবুব হোসেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবের গাড়িচালক, মো. শাহীন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ এর গাড়িচালক, মো. মতিউর রহমান প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-২ এর গাড়িচালক, মো. নূর হোসেন বেপারী প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ এর গাড়ি চালক, মো. বোরহান উদ্দিন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-২ এর গাড়ি চালক, মো. বেলাল হোসেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মশিউর রহমান (হুমায়ূন) এর গাড়িচালক, মো. মিজানুর রহমান চিফ ফটোগ্রাফারের গাড়িচালক, মো. বাচ্চু হাওলাদার প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার-১ এর গাড়িচালক, মো. নুরুল আলম প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ এর আওতাধীন শাখার গাড়ি চালক (গণভবন ও বঙ্গভবনে দিবারাত্রি নথিপত্র আনা-নেওয়ায় ব্যবহৃত গাড়ি), মো. নুরনবী (ইমন)- প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়ার গাড়িচালক, মো. শাহীন- প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার-২ এর গাড়ি চালক।
জানা গেছে, ছয়টি ৩ কাঠা আয়তনের প্লট এবং দুটি ৫ কাঠা আয়তনের প্লট তাদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়। তিন কাঠা প্লটের মূল্য প্রতিকাঠা ৪ লাখ করে ১২ লাখ এবং ৫ কাঠা আয়তনের প্লটপ্রতি কাঠা ৫ লাখ করে ২৫ লাখ টাকা।
প্রসঙ্গত, রাজউক বাস্তবায়নাধীন ঝিলমিল প্রকল্পে মোট ১ হাজার ৭৪০টি আবাসিক প্লট রয়েছে। মোট ৩৮১ দশমিক ১১ একর এলাকা নিয়ে এ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে।
এর আগে পূর্বাচলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা মিলে নিয়েছেন ৬০ কাঠার সরকারি প্লট। রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারের ১৩/এ ধারার ক্ষমতাবলে তাদের প্লট দেওয়া হয়। ২০২২ সালে তারা প্লট বুঝে পান। পরে বিষয়টি রাষ্ট্রীয় অতি গোপনীয় বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পরিবারের সদস্যরা প্রত্যেকে সর্বোচ্চ ১০ কাঠা আয়তনের প্লট নিয়েছেন।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
একই বিবেচনায় পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প এলাকায় ১০ কাঠার প্লট নিয়েছেন জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ফারজানা ইসলাম।