স্বাস্থ্যেও এস আলমের থাবা লুটেছে ৫শ কোটি টাকা

আজাদুল আদনান
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
স্বাস্থ্যেও এস আলমের থাবা লুটেছে ৫শ কোটি টাকা


ব্যবসা নয়, যেন লুটপাটই ছিল এস আলম গ্রুপের প্রধান লক্ষ্য। বিভিন্ন ব্যাংক লুটের সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতেও থাবা বসিয়েছিল চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগ্রুপটি। এই শিল্পগ্রুপ ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা দখলে নেওয়ার পর ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনও (আইবিএফ) কব্জা করে। ফাউন্ডেশনের অধীনে থাকা সেন্ট্রাল ল্যাবসহ ২৩টি জেনারেল ও স্পেশালাইজড হাসপাতাল আয়ত্তে নেয়। ২০২০ সালে এস আলম গ্রুপ যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অভিজ্ঞ সব কোম্পানিকে তাড়িয়ে দেয়। কেনাকাটার জন্য ২টি কোম্পানি খুলে গত প্রায় চার বছরে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনাকাটা ও সরবরাহ করে। এর মাধ্যমে ৫শ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। বাজারদরের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে যন্ত্র ও সরঞ্জামাদি কেনা এবং লোকাল পার্ট ধরে বিল ও বিনামূল্যে পাওয়া যন্ত্রপাতি ক্রয় দেখিয়ে এ হরিলুট করে এস আলম গ্রুপ।

আইবিএফ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইসলামী ব্যাংকের অর্থায়ন, ব্যাংকটির শরিয়াহর বাইরে হওয়া মুনাফা, ব্যক্তির অনুদান ও জাকাতের মাধ্যমে পরিচালিত হয় আইবিএফ। সেবামূলক হওয়ায় ফাউন্ডেশনটির হাসপাতালগুলোয় অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে সেবা পাওয়া যায়। হাসপাতালের যে কোনো কেনাকাটায় আগে কঠোর নিয়মকানুন মানা হতো। এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর কেনাকাটায় আইবিএফের কোনো নিয়ম মানা হয়নি। অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করা হয়।

এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলমের ভাগ্নে ডা. তানভির হাসপাতাল বিভাগে প্রভাব বিস্তার করে নিয়ম ভেঙে যন্ত্রপাতি কেনাকাটা শুরু করলে আপত্তি জানান কর্মকর্তারা। আপত্তি জানানো কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত ও সরিয়ে নিজেদের লোক বসানো হয়। 

চার বছরে ১ হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনাকাটা

২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের শুরু পর্যন্ত চার বছরে যন্ত্রপাতি কেনাকাটার আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য আইবিএফ দিতে পারেনি। সরেজমিন ফাউন্ডেশনটির পারচেজ, হাসপাতাল ও অ্যাকাউন্টস বিভাগের অন্তত ছয়জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। প্রত্যেকে জানান, এ সময়ে অন্তত ১ হাজার কোটি টাকার চিকিৎসা যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। এসব কেনাকাটার সবই হয়েছে এস আলমের অনভিজ্ঞ দুই কোম্পানির মাধ্যমে। এক টেন্ডারেই ৬টি এমআরআই (ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং), ৫টি সিটি স্ক্যান, ২টি ক্যাথ ল্যাব, ৭টি আল্ট্রাসাউন্ড, ১৮৭টি আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) বেড ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ল্যাব যন্ত্র ও সরঞ্জাম কেনা হয়েছে। এ ছাড়াও ২৫টি আল্ট্রাসনোগ্রাম, ইকো, ভেন্টিলেটর, আইসিইউ ভেন্টিলেটর, সিএসএসডি, পেশেন্ট মেশিন ও কার্ডিয়াক ওটি সরবরাহ করা হয়। এই বিপুলসংখ্যক রোগ নির্ণয় যন্ত্রপাতি কেনাকাটা ও সরবরাহে অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়।

আইবিএফের এক ঊর্ধŸতন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ‘২০২০ সাল থেকে ৯৯০ কোটি টাকার বেশি যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসাসামগ্রী কেনা হয়েছে। এর অধিকাংশই সেন্ট্রাল ল্যাবসহ ঢাকার সাতটি হাসপাতালে সরবরাহ করা হয়। এসব কেনাকাটায় লোকাল যন্ত্রাংশের নামে একটি বিভাগ খোলা হয়, যার মাধ্যমে কেনাকাটা করে কয়েকশ কোটি টাকা লুটে নেওয়া হয়। আবার সেন্ট্রাল ল্যাবের সব যন্ত্রপাতি বাজারদরের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে। একই কায়দায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপকরণও (রি-এজেন্ট) কেনা হয়।’ ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এগুলো নিয়ে যারাই প্রতিবাদ করেছে, তাদেরই চাকরিচ্যুত ও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ ফাউন্ডেশনটি মানুষের কল্যাণের জন্য করা হয়। জাকাতের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান অনুদান দিত। কিন্তু এস আলমের দুর্নীতির কারণে তারা চলে যায়। কমিশন-বাণিজ্য করেই ২শ কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নেওয়া হয়। সব মিলিয়ে প্রায় ৫শ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় এস আলম গ্রুপ।

অভিজ্ঞদের কাজ না দিয়ে কোম্পানি খুলেই কেনাকাটা

আইবিএফ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পরপরই নিজেদের নামে গ্লোবাল মেডিটেক ও ইউনিভার্সেল হেলথ কেয়ার নামে দুটি কোম্পানি খোলেন এস আলমের ভাগ্নে ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ডা. তানভীর আহমদ।

যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে হলে নিয়ম অনুযায়ী ন্যূনতম পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। কিন্তু ২০২০ সালের পর প্রতিটি দরপত্র আহ্বান করা হলে সিমেন্স, বায়োটেকসহ নামকরা সব কোম্পানি টেন্ডার দাখিল করে। এমনকি সাইট ভিজিটও করে সিমেন্স। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা কাজ পায়নি। কোনো ধরনের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও সরবরাহের সব দায়িত্ব দেওয়া হয় গ্লোবাল মেডিটেক ও ইউনিভার্সেল হেলথ কেয়ারকে। কেনাকাটায় ব্যাংকে এলসি করার কথা থাকলেও সব ধরনের এলসি হয়েছে আইবিএফের নামে।

৬০ লাখ টাকার যন্ত্র কেনা হয় সাড়ে ৮ কোটি টাকায়

কেনাকাটায় সবচেয়ে বড় দুর্নীতি হয়েছে কয়েকগুণ বেশি দামে যন্ত্র কেনার মাধ্যমে। রাজধানীর নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় (সেন্ট্রাল) ল্যাব চালু করা হয়। ল্যাব প্রতিষ্ঠায় ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা নানা আপত্তি জানালেও কেবল টাকা লোটার জন্যই এই প্রকল্প হাতে নেন এস আলমের ভাগ্নে। এসব যন্ত্রপাতিও কেনা হয় গ্লোবাল মেডিটেক ও ইউনিভার্সেল হেলথ কেয়ারের মাধ্যমে। ল্যাবটিতে রক্ত ও মূত্র থেকে শুরু করে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কেনা হয় অটোমেটেড ইউরিন কেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার, অটোমেটেড হেমাটোলজি অ্যানালাইজার, অটোমেটেড বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার, অটোমেটেড ইমিউনোসে অ্যানলাইজারের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি। 

সেন্ট্রাল ল্যাবের একাধিক প্রকৌশলী জানান, এসব যন্ত্রপাতি রি-এজেন্ট কেনার সঙ্গে বিনামূল্যে ও ভাড়ায় দেয় কোম্পানিগুলো। কোটি কোটি টাকার যন্ত্র কেনা হয়, দ্বিগুণ থেকে ১৪ গুণ পর্যন্ত বেশি দামে। এ খাত থেকেই প্রায় ৮০ কোটি টাকা হাতানো হয়।

ল্যাবএইড ও পপুলারের মতো প্রথম সারির হাসপাতালে ব্যবহৃত যে অটোমেটেড ইউরিন কেমিস্ট্রি অ্যানালাইজারের দাম ৬০ লাখ টাকা, একই যন্ত্র ১৪ গুণ বেশি দামে কেনা হয় ৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকায়। একইভাবে ৬৫ লাখ টাকার বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার কেনা হয় ১ কোটি ৯৩ লাখ টাকায়; ৮০ লাখ টাকার ইমিউনোসে অ্যানলাইজার কেনা হয় ১ কোটি ৪৬ লাখ টাকায়। এমনকি ইচ্ছেমতো রি-এজেন্টের দামও রাখা হতো।

একাধিক ল্যাব টেকনিশিয়ান আমাদের সময়কে বলেন, ‘যেগুলো বিনামূল্যে কিংবা ভাড়ায় পাওয়া যায়, সেগুলোও কয়েকগুণ বেশি দামে কেনা হয়। কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই ল্যাবটি করা হয়। ১৫০ কোটি টাকার ল্যাবে প্রতিমাসে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। অথচ এখানে চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা হওয়ার কথা। ল্যাবের প্রধান কনসালটেন্টের বেতন ৮ লাখ টাকা। একই মানের কনসালটেন্টের বেতন অন্য ল্যাবে ৩ লাখ টাকা। ফলে প্রতিমাসেই কোটি টাকার বেশি লোকসান গুনতে হয়। আবার হাসপাতালভেদে যন্ত্রপাতির প্রয়োজন না হলেও জোর করে কিনে বিল তোলা হয়েছে।’

লোকাল পার্ট নামে শতকোটি টাকার বিল

ছয়টি এমআরআই ও পাঁচটি সিটি স্ক্যান কিনতে গেছে ১১০ কোটি ২৬ লাখ টাকার বেশি। এসব যন্ত্র সচলে কোম্পানি থেকে সব ধরনের উপকরণ দিলেও ইনস্টল করতে গিয়ে লোকাল যন্ত্রাংশ দিয়ে প্রতিটি যন্ত্রের পেছনে এক থেকে দেড় কোটি টাকা করে হাতিয়ে নেওয়া হয়। এর পরিমাণ প্রায় ১৫ কোটি টাকার বেশি। একইভাবে দেড় কোটি টাকা মূল্যের দুটি ক্যাথ ল্যাব কেনা হয়েছে। আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন কেনা হয় ২৫টি। প্রতিটি কেনা হয় সাড়ে ৫ লাখ টাকায়। এসব যন্ত্রেও লোকাল আইটেমের নামে কোটি কোটি টাকার বিল করা হয়। এসব যন্ত্রপাতির একটি বড় অংশই রয়েছে মিরপুর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে। গত বছরের জুনে চালু হওয়া হাসপাতালটিতে প্রায় ২শ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয়। প্রয়োজনের বাইরেও সেখানে এমন কিছু যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে, যেগুলো অব্যহৃত অবস্থায় পড়ে আছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির এক কর্মকর্তা।

হাসপাতালটির আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘যে কোনো যন্ত্র প্যাকেজ আকারে থাকে। এমনকি উপকরণ অতিরিক্তও দেয় কোম্পানি। ২০১৯ সালের আগ পর্যন্ত যেসব যন্ত্র কেনা হয়েছে, সেখানে কখনই লোকাল পার্ট নামে কিছু ছিল না। যে কোম্পানি কাজ পেত তারাই ইউপিএস, কালার প্রিন্টার, টেবিলসহ সব ধরনের সরঞ্জাম দিত। কিন্তু ২০২০ সালের পর হঠাৎ করেই লোকাল পার্ট নামে একটি বিভাগ খোলা হয়। এরপর থেকেই যে কোনো যন্ত্র কেনা হলেই এই নামে আলাদা বিল হতো।’

অনিয়মের নেপথ্যে যারা

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিটি কেনাকাটার নিয়ন্ত্রণ করতেন স্বয়ং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ডা. তানভীর আহমদ। এসব অবৈধ কেনাকাটায় তাকে সহযোগিতা করতেন ক্রয় ও প্রাক্কলন বিভাগের ইনচার্জ মো. মুস্তাফিজুর রহমান, ফাউন্ডেশনের জিএম ইঞ্জিনিয়ার মো. আব্দুস সামাদ, অডিট ইনচার্জ মোশারফ হোসেন, কমিউনিটি হাসপাতালের ম্যানেজার ও ইনচার্জ মো. মনিরুজ্জামান, হাসপাতাল বিভাগের প্রধান মো. ইউনসু ও সেন্ট্রাল ল্যাবের পরিচালক তারেক আল নাসেরসহ অন্তত ১৫ জন কর্মকর্তা। টেন্ডার প্রক্রিয়া কেমন হবে তা ঠিক করতেন মুস্তাফিজুর রহমান। সব কাজের আদেশ হতো তার হাতেই। দরকষাকষি ও কারা কাজ পাবে, তাও ঠিক করতেন তিনি। অন্যদিকে রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের প্রধান হলেও পারচেজ কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন আব্দুস সামাদ। ক্রয় কমিটিরও সদস্য ছিলেন তিনি। স্পেয়ার পার্টস ক্রয়, নতুন হাসপাতাল ভবন নির্মাণ ও সংস্কারের দায়িত্ব তার থাকায় সুবিধা নিতেন সবচেয়ে বেশি।

আইবিএফের কর্মকর্তা জানান, তোষামদি ও চাটুকারিতাই ছিল আব্দুস সামাদের বড় যোগ্যতা। যা কাজে লাগিয়ে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে সাততলা বাড়ি করে দেন। এর মাধ্যমে কয়েক দফায় পদোন্নতি নেন।

এদিকে যাবতীয় কেনাকাটা ও তদারকির দায়িত্ব থাকলেও লোকবল নিয়োগে বড় প্রভাব ছিল অডিট বিভাগের প্রধান মো. মোশাররফের। এসব অনিয়মের ব্যাপারে টানা পাঁচ দিন কার্যালয়ে গিয়েও মুস্তাফিজুর রহমানসহ অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের পাওয়া যায়নি।

গত ৪ সেপ্টেম্বর ফাউন্ডেশনটি থেকে এস আলমের সময়ে নিয়োগ করা সব কর্মকর্তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তোপের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন মুস্তাফিজুর রহমানও।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

গত রবিবার কার্যালয়ে গেলেও এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি আইবিএফের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আলী।

জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক ও ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিল আমাদের সময়কে বলেন, ‘বিষয়গুলো নিয়ে ইতোমধ্যে কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। কোথায় ক গলদ হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হবে। অভ্যন্তরীণ ও আউটসোর্সিং অডিট বিভাগের মাধ্যমে এগুলো অনুসন্ধান করা হবে। আমাদের বোর্ডের সদস্যদের পরামর্শ আছে। অনেক সমস্যা ছিল এখানে। কম সময়ের মাধ্যমে এটি করার চেষ্টা করছি আমরা।’