৮ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিয়েছে ৩২০ কোটি টাকা
সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন করে বেক্সিমকোর শেয়ারে কারসাজির মাধ্যমে চার ব্যক্তি ও চার প্রতিষ্ঠান মিলে গড়ে ওঠা একটি চক্র হাতিয়ে নিয়েছে ৩১৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। একই সময়ে চক্রটি ৫২৬ কোটি টাকা ‘আনরিয়ালাইজড গেইন’ করেছে। বিষয়টি উঠে এসেছে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) একটি তদন্ত প্রতিবেদনে। তবে ২০২২ সালে এ তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হলেও এতদিন তা ধামাচাপা দিয়ে রাখা ছিল। অভিযোগ রয়েছে, পুজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তৎকালীন চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম এবং শেখ হাসিনা সরকারের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি বিএসইসি সূত্রে বিষয়টি জানা গেছে।
ডিএসইর তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেয়ার কারসাজিকারী চক্রটির চার ব্যক্তি হলেন আব্দুর রউফ, মোসফেকুর রহমান, মারজানা রহমান ও মমতাজুর রহমান এবং প্রতিষ্ঠানটি চারটি হল জুপিটার বিজনেস, অ্যাপোলো ট্রেডিং লিমিটেড, ক্রিসেন্ট লিমিটেড ও ট্রেডনেক্সট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ২ জানুয়ারি থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত বেক্সিমকোর শেয়ারের লেনদেন মূল্য ছিল ৪ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসে ভিন্ন ভিন্ন ক্লায়েন্ট কোডের মাধ্যমে এর ৭০ শতাংশের বেশি লেনদেন করেছে এই আট বিনিয়োগকারী। এর মাধ্যমে চক্রটি মুনাফা তুলে নিয়েছে ৩১৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। আর এ সময় তাদের আনরিয়ালাইজড গেইন (অবিক্রীত শেয়ার কেনা দামের চেয়ে মূল্য বেশি ছিল) ৫২৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
জানা গেছে, ২০২২ সালে জুপিটার বিজনেস ও ট্রেডেনেক্সট ইন্টারন্যাশনাল বিমান প্রতিষ্ঠান ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের শেয়ার অধিগ্রহণের পর পরিচালনা পর্ষদে ঢোকে। দুটি কোম্পানি ফারইস্টের বোর্ডে তাদের প্রতিনিধিত্বের জন্য বেক্সিমকো গ্রুপের সিনিয়র এক্সিকিউটিভদের মনোনীত করে। ট্রেডেনেক্সট ইন্টারন্যাশনাল বেক্সিমকো গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা জামানুল বাহারকে মনোনীত করে। অন্যদিকে জুপিটার বিজনেস বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা আলী নওয়াজ ও বেক্সিমকো টেক্সটাইলের জেনারেল ম্যানেজার মাসুম মিয়ার নাম সুপারিশ করে।
ডিএসইর অনুসন্ধান অনুসারে, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স ১৯৬৯-এর ধারা ১৭-এর বেশ কয়েকটি উপধারা লঙ্ঘন করে চক্রটি শেয়ার কারসাজি করেছে। ধারা ১৭ লঙ্ঘন একটি ফৌজদারি অপরাধ। সুবিধাভোগী বিনিয়োগকারী আব্দুর রউফ ছিলেন ইউনাইটেড সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী। অন্যদিকে ক্রিসেন্ট লিমিটেড প্রাইম ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সঙ্গে যুক্ত ছিল। মোসফেকুর রহমান, মমতাজুর রহমান অ্যান্ড দেওয়ার অ্যাসোসিয়েটস জুপিটার বিজনেস, অ্যাপোলো ট্রেডিং, মারজানা রহমান এবং ট্রেডনেক্সট ইন্টারন্যাশনাল জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের বিনিয়োগকারী ছিলেন। এই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কেউ কেউ গ্রিন ডেল্টা সিকিউরিটিজ, বেক্সিমকো সিকিউরিটিজ, শেলটেক ব্রোকারেজ এবং আইসিবি সিকিউরিটিজের সঙ্গে আলাদা বিও অ্যাকাউন্টও রেখেছিলেন। তারা বেক্সিমকো শেয়ারে সার্কুলার লেনদেন করেছিল, যেখানে কিছু বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করেছে এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যরা ভুয়া সক্রিয় ট্রেডিং দেখাতে একাধিক লেনদেনে এসব শেয়ার কিনেছে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ডিএসইর অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, ক্রিসেন্ট লিমিটেড বেক্সিমকো শেয়ারের শীর্ষ ক্রেতা ছিল। ক্রিসেন্ট লিমিটেডের পরিচালক ও যুগ্ম অপারেটর আব্দুর রউফ চারটি বিও অ্যাকাউন্ট দিয়ে শেয়ার লেনদেনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। এই ৪টি বিও অ্যাকাউন্টের মোট লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩৩.২৫ শতাংশ। জুপিটার বিজনেস লিমিটেড দ্বিতীয় শীর্ষ ক্রেতা ছিল। মোসফেকুর রহমান সক্রিয়ভাবে সাতটি বিও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ব্যবসায় অংশ নেন। আট বিনিয়োগকারীর গ্রুপ যৌথভাবে বেক্সিমকো শেয়ারের ২৪.৬১ শতাংশ লেনদেন করেছে।
একই ব্যক্তিরাই শীর্ষ বিক্রেতাদের মধ্যেও ছিলেন। একদিকে তারা শেয়ার কিনেছেন, অন্যদিকে সেগুলো বিক্রিও করেছেন। এসব কিছু করা হয়েছে স্রেফ স্টকটিকে সক্রিয় দেখানোর জন্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আব্দুর রউফের শেয়ারপ্রতি গড় ক্রয়মূল্য ছিল ১২২.২৯ টাকা এবং তার গড় বিক্রয়মূল্য ছিল ১৪৮.৮১ টাকা। ফলে তিনি প্রতি শেয়ার ২৬.৫২ টাকা লাভ করেছেন। ক্রিসেন্ট লিমিটেডের শেয়ারপ্রতি গড় ক্রয়মূল্য ছিল ১৩০.৬৮ টাকা। শেয়ারপ্রতি ১৯.৬৭ টাকা লাভ করে এটি ১৫০.৩৫ টাকায় শেয়ার বিক্রি করেছে।
মোসফেকুর রহমান, মমতাজুর রহমান অ্যান্ড দেওয়ার অ্যাসোসিয়েটসের শেয়ারপ্রতি গড় ক্রয়মূল্য ছিল ১১৩.২৯ টাকা এবং গড় বিক্রয়মূল্য ছিল ১৫১.৬৭ টাকা। অর্থাৎ প্রতি শেয়ারে তাদের গড় লাভ ৩৮.৩৮ টাকা। মোসফেকুর রহমানের শেয়ারপ্রতি ক্যাপিটাল গেইন ছিল ৫৯.৩১ টাকা। তার শেয়ারের গড় ক্রয়মূল্য এবং গড় বিক্রয়মূল্য ছিল যথাক্রমে ৯১.৪৫ টাকা ও ১৫০.৭৬ টাকা। জুপিটার বিজনেসের রিয়েলাইজড গেইন ছিল শেয়ারপ্রতি ২১.৪১ টাকা, যার গড় ক্রয়মূল্য ১৩২.৩৪ টাকা এবং গড় বিক্রয়মূল্য ১৫৩.৭৫ টাকা। মারজানা রহমানের শেয়ারপ্রতি লাভ ছিল ৩৫.৯৩ টাকা, যার গড় ক্রয়মূল্য ১১৩.২৫ টাকা এবং গড় বিক্রয়মূল্য ছিল ১৪৯.১৭ টাকা। ক্রয়মূল্য ১৩৪.৩৪ টাকা এবং গড় বিক্রয়মূল্য ছিল ১৬০.৬৮ টাকা ধরে ট্রেডনেক্সটের প্রতি শেয়ারের রিয়েলাইজড গেইন ছিল ২৬.৩৪ টাকা।
বেক্সিমকো শেয়ারের লেনদেন পর্যালোচনার পর ডিএসই জানায়, আবদুর রউফ এবং ক্রিসেন্ট লিমিটেড প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একাধিক লেনদেনকে প্রভাবিত করে আইন লঙ্ঘন করেছে, যা সক্রিয় লেনদেনের প্রপঞ্চ তৈরি করেছে এবং বেক্সিমকোর শেয়ারের মূল্য ক্রমশ বাড়িয়ে তুলেছে। তারা মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করে এভাবে ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে আইন লঙ্ঘন করেছে।
ক্রিসেন্ট লিমিটেড এবং মারজানা রহমান বিভিন্ন সময়ে লেনদেন করেছে; কিন্তু বেনিফিশিয়াল ওনারশিপে কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়ে আইন ভঙ্গ করেছেন। মোসফেকুর, মমতাজুর এবং তাদের সহযোগীরা, মারজানা এবং ট্রেডেনেক্সট ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে মিলে ধারাবাহিক লেনদেনের মাধ্যমে আইন লঙ্ঘন করেছে।
এ ছাড়া মোসফেকুর, মমতাজুর, জুপিটার বিজনেস, অ্যাপোলো ট্রেডিং লিমিটেড, মারজানা এবং ট্রেডনেক্সট ইন্টারন্যাশনাল সক্রিয় ট্রেডিংয়ের ভুয়া এবং বিভ্রান্তিকর চেহারা তৈরি করে আইন লঙ্ঘন করেছে। পাশাপাশি, মোসফেকুর, মমতাজুর এবং তাদের সহযোগীরা আইনি প্রক্রিয়া না মেনে বেক্সিমকোর ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার অধিগ্রহণ করে অধিগ্রহণ ও দখলের নিয়ম লঙ্ঘন করেছে।
বিএসইসি সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) বেক্সিমকোর শেয়ার কারসাজির তদন্ত প্রতিবেদন ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে বিএসইসিতে জমা দেয়। আর ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে তা কমিশন সবিচালয়ে পাঠনো হয়। কিন্তু দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও প্রতিবেদনটি হিমাঘরে আটকে থাকে। নিয়ম অনুসারে এ ধরনের কোনো প্রতিবেদন প্রথমে কমিশন সচিবালয়ে পাঠানো হয়। এরপর প্রতিবেদন নিয়ে কমিশন সচিবালয়ে কার্যক্রম শেষে তা কমিশন বৈঠকে তোলা হয়। কিন্তু বেক্সিমকোর শেয়ার কারসাজির বিষয়টি কমিশন বৈঠকে না পাঠিয়ে অজানা কারণে আর কমিশন বৈঠকে তোলা হয়নি। ফলে কারসাজির মাধ্যমে চক্রটি টাকা তুলে নিলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কমিশন।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
মূলত তৎকালীন বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণেই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কমিশন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পদত্যাগ করেন বিএসইসির তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবায়াত-উল ইসলাম। তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। আর সালমান এফ রহমান পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন। ফলে তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।