ঢাকা দক্ষিণ সিটি ছিল ‘তাপসের মুল্লুক’
২০১৮ সালের ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে ঢাকা-১০ আসনে সংসদ সদস্য হন ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। ২০১৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়ে প্রভাবশালী শেখ পরিবারের এই রাজনীতিবিদ জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভের পর ওই বছরের ১৬ মে মেয়র হিসেবে শহথ গ্রহণ করেন তিনি। গত ১৯ আগস্ট সরকার ডিএসসিসিসহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অপসারণ করে। এর আগ পর্যন্ত শেখ তাপসই ছিলেন ডিএসসিসির মেয়র। মেয়র থাকাকালীন তার স্বৈরাচারী শাসন, শোষণ, অপকর্ম ও দুর্নীতি নিয়ে টুঁ শব্দটি করার সাহস পাননি কেউ। এখন শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি তথা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল।
জানা গেছে, ডিএসসিসির মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে নিজেকে রীতিমতো ‘রাজা’ ভাবতে থাকেন শেখ ফজলে নূর তাপস। মেয়র হওয়ার পর দেশের বুদ্ধিজীবী, আলেম, বিচার বিভাগ, সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন, পরিবেশবিদসহ সবাইকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলতেন। কারও কোনো কথা, পরামর্শ, অনুরোধ পাত্তাই পেত না তার কাছে। এমনকি মন্ত্রীদের অনেককেও ধমক দিয়ে, তাচ্ছিল্য করে কথা বলতেন তিনি। সরকারি অন্য দপ্তরের প্রধানদের হুমকি দিতেন প্রায়ই।
ডিএসসিসির কর্মকর্তারা বলেছেন, শেখ তাপসের আচরণ ছিল খুবই স্বৈরাচারী। তিনি ছিলেন খুবই হিংসাত্মক। তার আগের মেয়াদের মেয়র সাঈদ খোকন যেসব উদ্যোগ নিয়েছিলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর একটা একটা করে সব বন্ধ করে দেন তাপস। যেসব প্রকল্প সাঈদ খোকন উদ্বোধন করেছেন, সেসব প্রকল্পের কাজ আর আলোর মুখ দেখেনি তাপসের হস্তক্ষেপে। এ কারণেই ডিএসসিসির অনেক মার্কেটের উন্নয়ন কাজ অসমাপ্ত অবস্থায় ফেলা রাখা হয়েছে। এতে করে সিটি করপোরেশনের কয়েক হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
দায়িত্ব গ্রহণ করেই কয়েকজন কর্মকর্তাকে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে চাকরিচ্যুত করেন মেয়র তাপস। দায়িত্ব
নেওয়ার পর তিনি নিজের একটা বলয় তৈরি করে ফেলেন। সিটি করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের সময়কে জানিয়েছেন, সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপসের হুকুম ছাড়া দক্ষিণ সিটির একটা পাতাও নড়ার সুযোগ ছিল না। দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ থেকে শুরু করে টেন্ডার, দোকান বরাদ্দ, উন্নয়ন প্রকল্প, উচ্ছেদ অভিযান যাই ঘটুক সব কিছুতেই তার অনুমতি লাগত।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
দক্ষিণ সিটির কর্মকর্তারা জানান, অনেক ফাইল প্রধান নির্বাহী পর্যন্ত গেলেই নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি সেটা মানতেন না। তারা বলেন, আমরা যদি দৈনিকভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগের তালিকাও করতাম, তিনি তার পছন্দের বাইরে কাউকে রাখতেন না। নিজেই নাম কেটে অন্য নাম অন্তর্ভুক্ত করতেন। শেখ পরিবারের সদস্য হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কথা বলার মতো সাহস কেউ দেখাত না।
প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের সময়কে জানান, আগে এই সিটিতে রাজার শাসন ছিল। এখানে তিনি যা বলতেন, তা-ই হতো। একজন পিয়ন নিতে গেলেও তার তালিকার বাইরে হতো না, যে কাজ আগে প্রধান নির্বাহী পর্যন্তই চূড়ান্ত হতো। তার ভয়ে পুরো অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মুখে কুলুপ এঁটে রাখতেন। চাকরি হারানোর ভয়ে সবাই তটস্থ থাকতেন।
ডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মী মো. শরিফ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, মেয়র তাপস টাকা খেয়ে অনেক লোকের চাকরি দিয়েছেন। তিনি সব সময় হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ করতেন। আগের মেয়র সাঈদ খোকন দক্ষ-অদক্ষ লোক হিসেবে ১ হাজার ২৭০ জনকে চাকরি দিয়েছিলেন। মেয়র তাপস আসার পর শুধু সাঈদ খোকন চাকরি দেওয়ার কারণে ৯০০ লোকের চাকরি খেয়ে ফেলেন। পরে নিজে ৪০০ লোকের চাকরি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটির স্থায়ী ৪৪ জনের চাকরিও খেয়েছেন তাপস। তিনি বলেন, আমি বিএনপির রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম শুধু এই অপরাধে পরিকল্পিতভাবে আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। আমি মেয়র তাপসের বিরুদ্ধে মামলা করব। তিনি অত্যন্ত ধুরন্ধর ছিলেন। নিজে সরাসরি কোনো টাকা লেনদেন না করলেও তার মূল কাজ করে দিতেন সচিব আকরামুজ্জামান। আমার জানা মতে, দক্ষিণ সিটিতে বিভিন্ন দপ্তরে ৪২ জনকে চাকরি দিয়েছেন সচিব আকরামুজ্জামান, যাদের চাকরি দিয়েছেন তারা সচিবের কোনো না কোনোভাবে পরিচিত। আমি অন্তত ১৭ জনের নাম জানি। আর ঠিকাদারি কাজের পার্সেন্টেজ লেনদেন হতো সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আশিকুর রহমানের মাধ্যমে। আশিক দেশে কোনো লেনদেন করতেন না। সব সময় সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় বসে লেনদেন করতেন।
তাপস মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০২০ সালের ১২ মে মধুমতি ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করে ডিএসসিসি। প্রসঙ্গত, এ ব্যাংকের অন্যতম বড় শেয়ারহোল্ডার তাপস নিজে। শুধু তাই নয়, ডিএসসিসির আর্থিক ফান্ড, ট্রেড লাইসেন্স, হোল্ডিং ট্রাক্সসহ সব ধরনের লেনদেন মধুমতি ব্যাংকে স্থানান্তর করা হয় তাপসের আমলে। এর মধ্যে ডিএসসিসির স্থায়ী আমানত ৫০০ কোটি টাকা এফডিআর হিসেবে মধুমতি ব্যাংকে স্থানান্তর করা হয়।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
এ নিয়ে আগের মেয়র সাঈদ খোকন প্রকাশ্যে অভিযোগ তুলেছিলেন। ফুলবাড়িয়া মার্কেটে উচ্ছেদ অভিযানকে কেন্দ্র করে মেয়র সাঈদ খোকন ও তাপসের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। দোকান বরাদ্দের নামে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন মেয়র তাপস। এরপর পাল্টা অভিযোগ তুলে সাঈদ খোকন বলেনÑ ‘তাপস মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে গলাবাজি করে চলেছেন। আমি তাকে বলব- রাঘব বোয়ালের মুখে চুনোপুটির গল্প মানায় না। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়তে হলে সর্বপ্রথম নিজেকে দুর্নীতিমুক্ত করুন, তারপর চুনোপুটির দিকে দৃষ্টি দিন। তাপস দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের শত শত কোটি টাকা তার নিজ মালিকানাধীন ব্যাংকে স্থানান্তর করেছেন এবং এই শত শত কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লাভ হিসেবে গ্রহণ করছেন।
শেখ ফজলুল হক মনির ছেলে শেখ ফজলে নূর তাপসের ঔদ্ধত্যপূর্ণ অনেক উক্তি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। একবার তিনি বলেছিলেন, ‘....একজন চিফ জাস্টিসকেও নামিয়ে দিয়েছিলাম। ...যে সকল সুশীলরা আমাদেরকে বুদ্ধি দিতে যাবেন, সেই সকল সুশীলদের আমরা বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গা নদীর কালো পানিতে ছেড়ে দেব।’ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙাকে কেন্দ্র করে তাপস আলেমদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘এক ৭ই মার্চের ভাষণেই শান্তিকামী বাঙালি গড়ে তুলে সশস্ত্রবাহিনী, গেরিলা যুদ্ধ করেছে। আমার বাবাও গেরিলা যুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন করেছেন, ট্রেনিং দিছেন, রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছেন নিজেও। সুতরাং, আমাদেরকে দুর্বল ভাইবো না। চুপ কইরা বইসা থাকি, সব সহ্য করি শুধু দেশের বৃহত্তর স্বার্থে, সংবিধানের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে।’
ভাস্কর্য ভাঙা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘জিগাইলাম ভাস্কর্য ভাঙছো, কেন ভাঙছো ভাই? বলেÑ ইসলাম। আরে ভাই, ইসলাম কি তোমার একার? মুসলমান কি তুমি একা? খৎনা কি তোমার একার হইছে, আমার হয় নাই? আরে, তোমার বাপ তোমারে পিটাইয়া মাদ্রাসায় পাঠাইছে আর আমি ঘরে বইসা আলিফ, বা, তা, ছা শিখছি। তোমারে জোর করছে বইলা তুমি শিখছ। আর আমি স্বইচ্ছায় শিখছি। তো তুমি আমার চাইতে বড় মুসলমান কোথা থেকে হইলা? আমি তিনটা ভাষা শিখছি- বাংলা, ইংরেজি, আরবি। তাও স্বইচ্ছায়। তুমি তো শিখছ পিটান খাইয়া। তাইলে তুমি বড় মুসলমান হইলা কীভাবে?’
রাজধানীর ধানমন্ডি সাত মসজিদ সড়কের আইল্যান্ডের গাছকাটা বন্ধে আহ্বান জানিয়েছিল পরিবেশবাদী ও সচেতন নাগরিকরা। বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ অনেকেই তখন মেয়র তাপসকে স্মারক লিপি দিয়েছিলেন তাদের সেই আবেদনও কর্ণপাত করেননি মেয়র তাপস।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
প্রসঙ্গত, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের সূত্রে জানা যায়, শেখ হাসিনার পতনের কিছুদিন আগে অবস্থা বেগতিক দেখে আগেভাগেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ তাপস।