দলে বিশৃঙ্খলা রোধে কঠোর অবস্থানে তারেক রহমান

নজরুল ইসলাম
০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
দলে বিশৃঙ্খলা রোধে কঠোর অবস্থানে তারেক রহমান

দলের শৃঙ্খলা ধরে রাখতে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে দলটির এই শীর্ষ নেতা বেশকিছু পদক্ষেপও নিয়েছেন। তারেক রহমান কতটা কঠোর তা স্পষ্ট করতে জাতীয় স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে শোকজ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন বলে দলের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে। তারেক রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সালাহউদ্দিন আহমেদ ছাড়াও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা কমিটি বিলুপ্ত করাসহ স্থানীয় তিন নেতার প্রাথমিকসহ সব পদ স্থগিত করা হয়েছে। গত ৫ আগস্টের পর এ পর্যন্ত সারাদেশে দেড় শতাধিক নেতাকে বহিষ্কার এবং অসংখ্য নেতাকে শোকজ করা হয়েছে।

সম্প্রতি দলীয় এক কর্মসূচিতে তারেক রহমান তার কঠোর মনোভাবের কথা জানান। তিনি বলেন, আপনারা পরাজিত অপশক্তির পাতা ফাঁদে পা দেবেন না। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে চূড়ান্ত সফলতায় নিতে হলে কেউ দখলদারি কাজে লিপ্ত হবেন না, সহায়তাও করবেন না। কেউ আইন নিজেদের হাতে তুলে নেবেন না।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। ২০১৫ সালের ১০ মে রাতে রাজধানীর উত্তরার একটি ভবন থেকে তাকে গুম করা হয়। ৩২ দিন পর ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং শহরের গলফ কোর্স ময়দান থেকে উদ্ধার হন সালাহউদ্দিন আহমেদ। ৯ বছর পর সম্প্রতি দেশে ফেরেন তিনি।

এস আলমের গাড়িতে চড়ে কক্সবাজারে নিজ নির্বাচনী এলাকায় সংবর্ধনা নিতে যান সালাহউদ্দিন। এই নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর তোলপাড় শুরু হলে তাকে শোকজ করেন তারেক রহমান।

সূত্র মতে, গত রবিবার রাতে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ডেকে সালাহউদ্দিনের সঙ্গে স্কাইপে কথা বলেন তারেক রহমান। সেখানেই এস আলমের গাড়িতে চড়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলেন। তারেক রহমানের নির্দেশে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ সংক্রান্ত চিঠি তার কাছে পাঠিয়ে দেন। চিঠিতে তিন দিনের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ভিন্ন ঘটনা-বিতর্কিত একজন ব্যবসায়ী সঙ্গে বৈঠক করায় শোকজ করা হয়েছে ডাকসুর সাবেক জিএস এবং বিএনপি যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনকেও।

এ নিয়ে দলের কোনো নেতাই বক্তব্য দিতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ না করে দলের গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতা আমাদের সময়কে বলেন, এই মুহূর্তে দলের শৃঙ্খলা ধরে রাখতে কত বড় নেতা বা কতটা ঘনিষ্ঠ- বিষয়টি দেখা হচ্ছে না। দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, অনেকেরই ধারণা তারেক রহমানের সঙ্গে এস আলমের সম্পর্ক আছে। সালাহউদ্দিনকে শোকজ করার মধ্য দিয়ে সেই ধারণারও অবসান ঘটল। এর মধ্য দিয়ে দলের নেতাদের কাছে বড় বার্তাও গেল।

এদিকে সালাহউদ্দিন ছাড়াও আওয়ামী লীগ নেতা ও বিতর্কিত ডায়মন্ড ব্যবসায়ী দিলীপ কুমার আগরওয়ালের সঙ্গে বৈঠক করায় শোকজ করা হয়েছে দলের যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনকে। চিঠি পাওয়ার পর জবাবও দিয়েছেন খোকন।

বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলমের বিলাসবহুল ১৪টি গাড়ি নিজের কব্জায় নেওয়ায় চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, প্রথম যুগ্ম আহ্বায়ক মো. এনামুল হক এনাম ও আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এস এম মামুন মিয়ার প্রাথমিক সদস্যসহ সব পর্যায়ের পদ স্থগিত করা হয়েছে।

গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখল, দলের নীতিপরিপন্থি বক্তব্যসহ নানা অভিযোগে বিএনপি ও অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর এ পর্যন্ত দেড় শতাধিক নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া অনেকের পদাবনতি, পদস্থগিতসহ নানাভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। শাস্তি পাওয়া নেতাদের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছেন ঢাকা মহানগর, বগুড়া, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরিশাল, পঞ্চগড়, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নরসিংদী, নোয়াখালী, ঝিনাইদহ, লালমনিরহাট ও লক্ষ্মীপুর জেলার। এ ছাড়া বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয়ভাবে নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

সাংগঠনিকভাবে শাস্তির কবলে পড়া নেতাদের মধ্যে রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুকে পদাবনতি করে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদ থেকে জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য করা হয়েছে। পুকুর দখলের ঘটনায় বিলকিস জাহান শিরিনকে বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ফরিদপুরে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে একজন নেতা নিহত হওয়ার ঘটনায় শামা ওবায়েদের দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও শহিদুল ইসলাম বাবুলের পদ জাতীয়বাদী কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক পদ স্থগিত করা হয়েছে। দলের একজন নেতা জানান, রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আলোচিত-সমালোচিত সাদিক এগ্রোর জায়গায় বিএনপির সাইনবোর্ড ব্যবহার করে একটি মহল দখলের চেষ্টা করে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নজরে আসার পর তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা মহানগর উত্তরের নেতাদের কড়া নির্দেশ দেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। সে অনুযায়ী সেখানে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

শুধু তাই নয়, দলে অনুপ্রবেশ ঠেকাতেও কঠোর অবস্থানে তারেক রহমান। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দলের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এরই মধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিএনপির ওয়ার্ড থেকে জাতীয় পর্যায় এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ওয়ার্ড থেকে কেন্দ্রীয় কমিটি পর্যন্ত কোনো স্তরেরই অন্য দলের নেতাকর্মী বা অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে যোগদান করানো যাবে না।

সালাহউদ্দিনের বক্তব্য

এস আলমের ‘গাড়িতে চড়ে সালাহউদ্দিন আহমের সংবর্ধনা’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরের জবাব দিতে গতকাল গুলশানের নিজ বাসায় ডাকা সংবাদ সম্মেলনে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, গত ২৮ আগস্ট বিমানবন্দর থেকে আমার নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। এ অবস্থায় কোনো গাড়ি প্রবেশের সুযোগ ছিল না। আমি বিমানবন্দরে নামার পর নেতাকর্মীরা বিভিন্ন গাড়িতে উঠতে বলেন। এই গাড়িটি কার সেই মুহূর্তে আমি চিন্তাভাবনার মধ্যে ছিলাম না, অনেকটা আবেগাপ্লুত ছিলাম। আমার ভাবনার মধ্যে ছিল না কার গাড়িতে উঠছি। বিএনপির এই নেতা বলেন, সংবাদ প্রকাশের পর খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আমার এলাকার এক ছোট ভাইয়ের; তিনি ওই কোম্পানির (এস আলম) জমিজমা দেখাশোনার কাজ করেন। আমি যদি জানতাম তা হলে উঠতাম না। এ অসাবধানতা ও অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য দুঃখপ্রকাশ করছি।

খায়রুল কবির খোকনের জবাব

বিতর্কিত ডায়মন্ড ব্যবসায়ী দিলীপ কুমার আগরওয়ালের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন। এ সংক্রান্ত খবর সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর খোকনের কাছে ব্যাখ্যা চায় বিএনপি। গতকাল খোকন বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেখানে খোকন উল্লেখ করেন, ‘আমাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জুলকারনাইন সায়ের ফেসবুক পোস্ট প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য হচ্ছে- গত ৩১ আগস্ট আমাকে কেন্দ্র করে একটি পোস্টে যা বলা হয়েছে তা একান্তই সত্যের অপলাপ। এতে করে একটি অনভিপ্রেত বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। এটি রীতিমতো আমার জন্য অস্বস্তিকর।