মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ ১৬ ব্যাংক

ঘাটতি পূরণের আশা দেখছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক

জিয়াদুল ইসলাম
০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ ১৬ ব্যাংক

বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম ও লুটপাটের কারণে ব্যাংক খাতে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। ফলে এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোর মূলধন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও বেড়েছে। কিন্তু নিয়ম মেনে অনেক ব্যাংকই তা সংরক্ষণ করতে পারছে না। সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চ ত্রৈমাসিকে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে সরকারি-বেসরকারি

অন্তত ১৬টি ব্যাংক। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বছরের পর বছর ঘাটতি নিয়ে চলছে। শিগগির এসব ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতির আশা দেখছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ, তারা ঘাটতি পূরণের যে কর্মপরিকল্পনা দাখিল করে আসছে, তা স্বল্প ও মধ্য মেয়াদের জন্য সহায়ক নয়। এ অবস্থায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে মূলধন পরিস্থিতি উন্নীতকরণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ব্যাংকগুলোকে আবারও নির্দেশনা দিতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

মূলত খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণেই ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। তবে ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতি যে পরিমাণ দেখানো হচ্ছে, তার তুলনায় প্রকৃত ঘাটতি আরও অনেক বেশি। কারণ, অনেক ব্যাংকই প্রভিশন সংরক্ষণে ডেফারেল সুবিধাও গ্রহণ করেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, কোনো ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে থাকলে তার আর্থিক ভিত্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ফলে ওই ব্যাংকের ওপর গ্রাহকের আস্থা কমে যায়, অন্য দেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে তাদের অসুবিধায় পড়তে হয়। তাই ব্যাংকগুলোর মূলধন ভিত্তি শক্তিশালী করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, প্রতি তিন মাস পর পর ব্যাংক থেকে কর্মপরিকল্পনা চাওয়া হয়। ব্যাংকগুলো তা দাখিল করে। কিন্তু তাদের কর্মপরিকল্পনা বরাবরই গতানুগতিক। ফলে তা থেকে ভালো ফলাফল মেলে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, তফসিলি ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম চালানোর জন্য ন্যূনতম রক্ষিতব্য মূলধন (এমসিআর) ও ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফার (সিসিবি) থাকতে হবে তাদের মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ ও আড়াই শতাংশ হারে। সেই সঙ্গে মূলধন ও দায়ের মধ্যে যথাযথ ভারসাম্য রক্ষায় ব্যাসেল-৩ কাঠামোর আলোকে ঝুঁকিভিত্তিক মূলধন পর্যাপ্ততার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে ২০১৫ সাল থেকে ন্যূনতম ৩ শতাংশ লিভারেজ অনুপাত (এলআর) সংরক্ষণ করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়, যা ২০২৩ সাল হতে বাৎসরিক দশমিক ২৫ শতাংশ হারে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধিপূর্বক ২০২৬ সালে ৪ শতাংশে উন্নীত করার নির্দেশনা রয়েছে। সে অনুযায়ী ২০২৪ সালের জন্য তফসিলি ব্যাংকগুলোকে লিভারেজ অনুপাত ন্যূনতম সাড়ে ৩ শতাংশ হারে সংরক্ষণ করার নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে গত মার্চ ত্রৈমাসিকে ১৬টি ব্যাংক এই নিয়ম মেনে মূলধন সংরক্ষণ করতে পারেনি। এ তালিকায় থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি, বিশেষায়িত দুটি ও বেসরকারি খাতের ৯টি ব্যাংক হচ্ছে- জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, এবি ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। এর মধ্যে প্রথম আটটি ব্যাংক এমসিআর, সিসিবি ও এলআর সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। পরের ৯টির মধ্যে কোনোটি সিসিবি ও এলআর, কোনোটি এমসিআর ও সিসিবি এবং কোনোটি শুধু সিসিবি সংরক্ষণে ব্যর্থ।

জানা যায়, মূলধন ঘাটতি পূরণ, সিসিবি সংরক্ষণ ও এলআর ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার লক্ষ্যে ব্যাংকগুলোর কাছে গত মাসে কর্মপরিকল্পনা চেয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো তা দাখিল করেছে। এর মধ্যে এমসিআর, সিসিবি ও এলআর সংরক্ষণে ব্যর্থ আটটি ব্যাংকের সাতটি তাদের কর্মপরিকল্পনায় জানায়, পরিচালন ব্যয় কমিয়ে মুনাফা বৃদ্ধি করা, খেলাপি ঋণের হার হ্রাস, খেলাপি ঋণের বিপরীতে আদায় বৃদ্ধির মাধ্যমে ইন্টারেস্ট সাসপেন্সে আটকা অর্থ আয় খাতে স্থানান্তর ও ঋণ আদায় কার্যক্রম জোরদার করা, ব্যাংকের সুদ আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে মুনাফা এবং রিটেইনড আর্নিস বৃদ্ধিকরণ, আবশ্যিক প্রভিশনের পরিমাণ হ্রাসকরণ ও জামানত বুদ্ধিসহ ঋণ বিতরণে সিকিউিরিটি কভারেজ বৃদ্ধির কৌশল গ্রহণ, আয় বৃদ্ধি ও ব্যয় হ্রােেসর মাধ্যমে লোকসান হ্রাস করা, মামলা নিষ্পত্তিকরণের মাধ্যমে ঋণের অর্থ আদায়, সরকারি ইক্যুইটির বিপরীতে সাধারণ শেয়ার ইস্যু, সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যু, ভালো রেটিং মানসম্পন্ন ঋণ গ্রহীতার অনুকূলে ঋণ বিতরণ, রেটিংকৃত ঋণ গ্রাহকের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সরকারি খাত ও এসএমই খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে বিদ্যমান মূলধন ঘাটতি পূরণ করা হবে। আর এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের কথা জানিয়েছে পদ্মা ব্যাংক।

অন্যদিকে সিসিবি ও এলআর সংরক্ষণ ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। এমসিআর ও সিসিবি সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে এবি ব্যাংক। কনসোলিডেটেড ও সলো ভিত্তিতে সিসিবি সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। এ ছাড়া কনসোলিডেটেড ও সলোভিত্তিতে সিসিবি সংরক্ষণে ব্যর্থ চারটি ব্যাংক হচ্ছে- আইএফআইসি ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। ব্যাংকগুলো এই ঘাটতি পূরণে যে কর্মপরিকল্পনা দাখিল করেছে, তার মধ্যে আছে- গুণগত ঋণ বৃদ্ধি, শ্রেণিকৃত ঋণের হার হ্রাস, পরিচালন মুনাফা বৃদ্ধি, শ্রেণিকৃত ও অবলোপনকৃত ঋণ হতে আদায় বৃদ্ধি, প্রভিশন কমানো, রিটেইনড আর্নিস বৃদ্ধিকরণ, নিট সুদ আয় বৃদ্ধি, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ হ্রাস করার পরিকল্পনা গ্রহণ, সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যু, রাইট শেয়ার ইস্যু করা ও লোকসানি শাখার সংখ্যা হ্রাস করা।

ব্যাংকগুলোর এসব কর্মপরিকল্পনা পর্যালোচনা করে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অফসাইট সুপারভিশন বিভাগ থেকে একটি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এতে বলা হয়- ব্যাংকগুলো সমস্যা উত্তরণের জন্য যেসব কর্মপরিকল্পনার কথা বলেছে তা স্বল্প কিংবা মধ্য মেয়াদি সময়ের জন্য সহায়ক নয়। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে মূলধন ঘাটতি চলমান থাকা সত্ত্বেও বিগত ত্রৈমাসিকগুলোতে মূলধন ঘাটতি নিরসনে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার বিপরীতে প্রায় অভিন্ন বা গতানুগতিক জবাব দাখিল করে আসছে। অন্যদিকে দিন দিন ব্যাংকগুলোর মূলধন পরিস্থিতির ধারাবাহিক অবনমন ঘটে চলেছে। অর্থাৎ, মূলধন ঘাটতির উন্নয়নে প্রণীত কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোর নেওয়া পদক্ষেপে আর্থিক পরিস্থিতির বাস্তব উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মূলধন ঘাটতিতে থাকা সরকারি ব্যাংক এবং কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক তাদের ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণের লক্ষ্যে প্রতি বছর প্রভিশন ঘাটতি সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক হতে ডেফারেল সুবিধা গ্রহণ করছে, যার ফলে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির প্রকৃত চিত্র আর্থিক বিবরণীতে প্রকাশ পাচ্ছে না। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা আর্থিক পরিস্থিতির অবনমন রোধ এবং আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষায় গৃহীত ব্যবস্থাদির অংশ হিসেবে আর্থিক সূচকে দুর্বল কয়েকটি ব্যাংকের সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক এমওইউ স্বাক্ষর করেছে। এর আওতায় ব্যাংকগুলোকে আগামী তিন বছরে (২০২৩ হতে ২০২৫ সালের মধ্যে) তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নকল্পে বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।