অনূর্ধ্ব-২০ সাফ ট্রফি বাংলাদেশের ঘরে
জাতির জীবনে ঘটনাবহুল সময়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে তিন বিভাগে অসাধারণ খেলে ১০ উইকেটে জয় লাভ। এর পর অনূর্ধ্ব-২০ সাফ ফুটবলে ভারতের বিপক্ষে নেপালে ৪-৩ গোলে জয়ী হয়ে ফাইনালে পৌঁছানো এবং ফাইনালে যুবদল পরিকল্পনামাফিক এবং এক পর্যায়ে কৌশল পরিবর্তন করে দাপটের সঙ্গে খেলে নেপালকে ৪-১ গোলে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো বয়সভিত্তিক সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে ট্রফি জয় করেছে। অনূর্ধ্ব-২০ এর যুবারা বুঝিয়ে দিয়েছে বাঁধনহারা তারুণ্যের বিকল্প নেই। শুধু ক্রীড়াঙ্গন নয়, সব ক্ষেত্রেই এই তারুণ্য বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেÑ হারতে দেবে না। বাংলাদেশ পুরুষ জাতীয় দল সেই ২০০৩ সালের পর আর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা ছুঁয়ে দেখতে পারেনি। আমরা বিশ্বাস করি মনমানসিকতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের পাশাপাশি ফুটবলে বড় ধরনের সংস্কার সাধন করা সম্ভব হলে বর্তমানের তরুণ জেনারেশন, যারা ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের নায়ক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এরাই পারবে বাংলাদেশের পতাকাকে আন্তর্জাতিক ফুটবল চত্বরে সম্মানের সঙ্গে ওপরে তুলে ধরতে। ফুটবলের জয়যাত্রা নিশ্চিত করতে।
মাঠের লড়াইয়ে নেপাল প্রথম থেকে চেষ্টা করেছে খেলাকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে। দল হিসেবে তারা ভালো এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। নেপাল মানসিক চাপে ভুগেছে সবচেয়ে বেশি। এতে তাদের খেলা কিছুটা এলোমেলো হয়েছে। বাংলাদেশের কোচ এই সময় তার কৌশল পাল্টে সুযোগ নিয়েছেন। খেলোয়াড়রা তাদের কাজ সঠিকভাবে করতে পেরেছে। যুবদলের মিরাজুল দুটি এবং রাব্বি হোসেন ও পিয়াস আহমদ একটি করে গোল করেছে। যেটি লক্ষণীয় হয়েছে সেটি হলো দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে ‘টিম স্পিরিট’ এবং সমঝোতা। কোচ খেলোয়াড়দের লড়াইয়ের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে তাদের সামর্থ্যকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছেন। খেলোয়াড়রা সৃষ্টি করেছে ইতিহাস।
চলতি বছরেই অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবলে বাংলাদেশের মেয়েরা নেপালকে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এর পর আবার ২৮ আগস্ট অনূর্ধ্ব-২০ এর যুবাদল নেপালকে বড় গোলের ব্যবধানে পরাজিত করে প্রথম শিরোপা জিতল। এটি দেশের ফুটবলে অনেক বড় পাওয়া।
বয়সভিত্তিক ফুটবলে ভারত ও নেপাল অপ্রতিরোধ্য এই ধারণা পাল্টে ফেলার স্পষ্ট বার্তা আমরা পেয়েছি। তারুণ্যকে সুযোগ করে দিতে হবে যাতে তারা বয়সভিত্তিক ফুটবলে অচিরেই ভারত এবং নেপালের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
খেলা শেষে গোল্ডেন বুটজয়ী (চ্যাম্পিয়নশিপে ৪টি গোল করেছে) সিরাজুল বলেছে, ‘দেশে এখন খারাপ অবস্থা, অনেক কিছু হয়েছে, বন্যা চলছেÑএই পুরো খেলাটা আমরা বাংলাদেশের মানুষের জন্য খেলেছি। আর কোচ মারুফুল হক বলেছেন, এই ‘ট্রফি উৎসর্গ করছি নতুন বাংলাদেশের জন্য, যে নায়করা জীবন দিয়েছে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘এই জয় নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে সবাইকে অনুপ্রাণিত করবে।’ ক্রীড়া দল-মত নির্বিশেষে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে তা আবার আমরা দেখলাম।
বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম খেলায় ২-০ গোলে শ্রীলংকাকে পরাজিত করেছে। প্রথম ম্যাচে জয় সব সময় মানসিক শক্তি এবং আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। এর পরের খেলায় স্বাগতিক নেপালের বিপক্ষে ২-১ গোলে পরাজিত হয়ে দ্বিতীয় দল হিসেবে ভারতের বিপক্ষে সেমিফাইনাল খেলেছে। নেপাল দলটি অনেক বেশি গোছানো এবং ‘কমপেক্ট’ ফুটবল খেলে। আর এই দলটি নিচের থেকে ধাপে ধাপে ওপরে উঠেছে। খেলোয়াড়দের খেলার প্রতি নিবেদন এবং ফুটবল ‘সেন্স’ পরিপক্ব। ওরা জানে মাঠে কীভাবে লড়তে হবে।
২০২২ সালে প্রথম অনূর্ধ্ব-২০ সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথমবারের কম্পিটিশনে বাংলাদেশ দল ভারতের কাছে হেরেছে। এর আগে অনূর্ধ্ব-১৮ ও ১৯ বয়সীদের প্রতিযোগিতা চারবার অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৮ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে খেললেও ট্রফি জিততে পারেনি। আর অনূর্ধ্ব-১৯ এর ফাইনালে কখনো খেলতে পারেনি। এবারই প্রথম শিরোপা জয়ের স্বাদ। দেশের ফুটবল একটি অস্থিতিকর সময় পার করছে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। এই সময় তরুণদের ফুটবল মাঠে জয় অবশ্যই বড় ধরনের স্বস্তি।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
নেপালের আলফা কমপ্লেক্সে নামার আগে থেকেই বাংলাদেশের তরুণ খেলোয়াড়রা ছিল ইতিবাচক। তারা তাদের শতভাগ ঢেলে দিয়ে চেষ্টা করেছে বলেই ট্রফি জয় সম্ভব হয়েছে। ছেলেরা দেশে সব সময় খেলে টার্ফে আর সেখানে খেলেছে ‘আর্টিফিসিয়াল’ টার্ফে। এ ক্ষেত্রে ‘অ্যাডজাস্টমেন্টের’ বিষয় ছিল। ছেলেরা এই বিষয়টি সহজে আয়ত্ত করতে পেরেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো লড়াইয়ে নামার আগে জয়ের ক্ষুধায় ভোগা এবং সামর্থ্যরে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা রাখা।
উয়েফা ‘এ’ লাইসেন্সধারী কোচ মারুফুল হক দুই সপ্তাহ সময় পেয়েছেন দলটাকে যতটুকু সম্ভব ঘষেমেজে দাঁড় করানোর জন্য। কোচের সুবিধা ছিল স্কোয়ার্ডের প্রায় সবাই প্রফেশনাল লিগে বিভিন্ন দলের হয়ে খেলেছেন এবং তারা মাঠের লড়াইয়ে অভিজ্ঞ।
ইকরামউজ্জমান : কলাম লেখক ও বিশ্লেষক; সাবেক সিনিযর সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া