কালো টাকা সাদা করার বিধান বন্ধের সিদ্ধান্ত
কালো টাকা সাদা করার বিতর্কিত বিধান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। গতকাল বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) শিগগির এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করবে।
সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রেখেছিল সর্বশেষ অর্থবছরের বাজেটেও। এতে করে যারা বৈধ উপায়ে আয় করেন তাদের ক্ষেত্রে কর ছিল ৩০ শতাংশ। অথচ কালো টাকার মালিকদের জন্য ছিল ১৫ শতাংশ। টিআইবিসহ দেশের অর্থনীতিবিদরা বরাবরই বলে আসছিলেন, এটা সম্পূর্ণভাবে বৈষম্যমূলক ও দুর্নীতি সহায়ক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কালো টাকা সাদা করার বিধান বন্ধের সর্বশেষ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার, তা আর্থিক দুর্নীতি রোধে ও বৈষম্য নিরসনে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ গত ১৫ বছরে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। পরবর্তী সময় ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি দায়িত্ব নিয়েই দেশের আর্থিক খাতের অনিশ্চয়তা কাটানোর ঘোষণা দেন। ২০ আগস্ট ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে এক
বৈঠকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুস জানান, অন্তর্বর্তী সরকার একটি ভঙ্গুর অর্থনীতির ভার নিয়েছে। এ সময় তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, উল্লেখযোগ্য সংস্কার হলে অর্থনীতি শিগগিরই ঘুরে দাঁড়াবে। দায়িত্ব নিয়েই প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন সংস্কার শুরু করেন। একই সঙ্গে বৈষম্য দূর করতে উদ্যোগী হন। ছাত্র আন্দোলনটির মূল দাবি- বৈষম্য নিরসন, রাষ্ট্র সংস্কার ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া সংবিধান পরিপন্থীই শুধু নয়, ছাত্র আন্দোলনের যে লক্ষ্য ছিল বৈষম্য নিরসন ও ন্যায্যতার, সেই লক্ষ্যেরও বিরোধী।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে যে কাউকে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার সেই সুযোগ আর রাখছে না। এর আগে গত ১৪ আগস্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আবদুর রহমান খানকে এনবিআর চেয়ারম্যান করে অন্তর্বর্তী সরকার। তিনি দায়িত্ব নিয়েই এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, এই ধরনের সুযোগ দুর্নীতির বিস্তার ঘটায় এবং সৎ করদাতাদের মনোবল ভেঙে দেয়। একজন সৎ করদাতা দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত কর দিয়ে আসেন। আরেকজন বছরের পর বছর কর ফাঁকি দেন। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়ে পরে কম হারে কর দেন। এটি ঠিক নয়। যদিও অতীতে বহুবার এমন হয়েছে।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে সব মিলিয়ে অপ্রদর্শিত প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা সাদা করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান ও এরশাদের ১৫ বছরে মাত্র ৯৫ কোটি টাকা সাদা হয়। আওয়ামী লীগের শেষ তিন মেয়াদে (২০০৯-২৩) প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা সাদা হয়।
এর আগে ২০০৬-০৭ সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। প্রকাশ করা হয়েছিল সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের তালিকা। তখন প্রায় ৩২ হাজার করদাতা ১১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা সাদা করেন। মূলত ভয়েই তখন প্রচুর মানুষ সুযোগটি নেন।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ আমাদের সময়কে বলেন, কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ রাখা হয়েছিল তা বৈষম্যমূলক; কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই সুযোগ দিয়ে সৎ করদাতাদের প্রতি অন্যায় করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিল করায় বৈষম্য কমবে বলে মনে করেন তিনি। তিনি যোগ করেন, এ সরকার বৈষম্য নিরসনের জন্যই ক্ষমতায় এসেছে।