নাকের ছোট্ট অস্ত্রোপচারে গিয়ে দিতে হলো প্রাণ

আজাদুল আদনান
২৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
নাকের ছোট্ট অস্ত্রোপচারে গিয়ে দিতে হলো প্রাণ

নাকের পলিপ অপারেশন করাতে হবে। ছোট্ট অস্ত্রোপচার। সময় লাগবে মাত্র ৩০ মিনিট। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলা হলো, রোগী অপারেশনের জন্য শারীরিকভাবে ফিট আছেন। অতঃপর তাকে নিয়ে যাওয়া হলো অপারেশন থিয়েটারে (ওটি)। এরপর নির্ধারিত সময়ের পরও অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। কিন্তু রোগীকে ওটি থেকে বের করা হচ্ছে না। দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর রোগীর উদ্বিগ্ন স্বজনরা ঢুকে পড়েন ভেতরে। গিয়ে দেখেনÑ রোগীর নাক রক্তাক্ত, শ^াস-প্রশ^াসও চলছে না! প্রশ্ন করা হলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা জানান, রোগী মারা গেছেন। মর্মবিদারক এ ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর কলাবাগানের কমফোর্ট হাসপাতালে। নাকের ছোট্ট একটি অস্ত্রোপচার করাতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে মিনিস্টার-মাইওয়ান গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক সামসুদ্দোহা শিমুলকে। ঠিক কী কারণে তার মৃত্যু হয়েছে, এর সদুত্তর নেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের

কাছে। অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসকও নীরব।

দুই বছর আগে ভুল চিকিৎসা দেওয়ায় এক বছরের জন্য নিবন্ধন স্থগিত হয়েছিল রাজধানীর ইমপালস হেলথ সার্ভিসেস অ্যান্ড রিচার্স সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহীর আল-আমীনের। ওই সময় রোগী প্রাণে বাঁচলেও এবার তার অস্ত্রোপচারে শিমুল ফিরলেন লাশ হয়ে।

গত ২০ আগস্ট এ ঘটনা ঘটে। এ মৃত্যুর দায় পুরোটাই চিকিৎসকের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আরও দুঃখজনক হলোÑ এ কাণ্ডে করা মামলায় সে রাতেই অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসক ডা. জাহীর ও অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া ডা. ইফতেখারুল কাওছারকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই গতকাল বৃহস্পতিবার জামিনে বেরিয়ে এসেছেন তারা। অথচ ভুল চিকিৎসার শিকার শিমুলের লাশ তখনো দাফন হয়নি।

কলাবাগান থানায় শিমুলের পরিবার অবহেলাজনিত মৃত্যুর এই মামলাটি করেছে। এতে ডা. জাহীর আল আমিনসহ চারজনকে আসামি করা হয়েছে। অন্য আসামিরা হলেন ডা. ইফতেখারুল কাওছার (৩৭), কমফোর্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যান্ড নার্সিং হোমের চেয়ারম্যান কবির আহামেদ ভূঁইয়া (৬০) এবং কমফোর্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সামিয়া ইসলাম (৫০)।

মামলার এজাহার থেকে জানা গেছে, ১২ আগস্ট নাকের সমস্যা নিয়ে গ্রিন রোডের কমফোর্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যান্ড নার্সিং হোমে ডা. জাহীর আল-আমীনের কাছে যান শিমুল। তিনি শিমুলকে নাকের পলিপ অপারেশন করাতে বলেন। ছোট এই অপারেশনটি সর্বোচ্চ ৩০ মিনিটের মতো সময় লাগার কথাও জানান। তবে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার ২ ঘণ্টা পর তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

শিমুলের ভাগিনা মো. রিয়াজ ইসলাম জানান, ১৯ আগস্ট শিমুলকে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে দেওয়া হয়। পরীক্ষার রিপোর্ট ভালো আসে এবং তিনি অপারেশনের জন্য ফিট আছেন বলে রিপোর্টে জানা যায়। ২০ আগস্ট দুপুর ৩টায় শিমুলকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অপারেশনের জন্য রাত সোয়া ১১টায় ওটিতে নিয়ে যায় এবং এনেস্থিসিয়া দিয়ে অজ্ঞান করা হয়। রাত ১২টায় ছোট ছোট অনেকগুলো হাড়ের টুকরো এনে দেখিয়ে ডা. জাহীর জানান, অপারেশন শেষ। ১০ মিনিট পর পোস্ট অপারেটিভ রুমে এনে রাখা হবে। কিন্তু প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও পোস্ট অপারেটিভ রুমে আনা হয়নি। সংশ্লিষ্টদের বারবার জিজ্ঞাসা করা হলে তারাও সন্দেহজনক আচরণ করেন এবং ইসিজি মেশিন ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে ওটিতে প্রবেশ করেন।

রিয়াজ বলেন, উদ্বিগ্ন অবস্থায় আরও প্রায় আধা ঘণ্টারও বেশি অপেক্ষা করার পর হাসপাতালের কয়েকজনকে তড়িঘড়ি করে চলে যেতে দেখি। আমাদের সন্দেহ হয়। রাত সোয়া ১টায় আমরা সরাসরি অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করে দেখি, মামার নাক দিয়ে প্রচুর রক্ত ঝরছে এবং তিনি  শ্বাস-নিঃশ্বাস নিচ্ছেন না। এরপর ডা. জাহীর ও ডা. ইফতেখার বলেন, ‘দুঃখিত, আপনাদের রোগী মারা গেছে।’ এ কথা বলার সময় আমি ডা. জাহীর আল আমীনের মুখ থেকে মদের গন্ধ পাই। মোট ১ লাখ টাকার মতো খরচ হতো অপারেশনে। টেস্ট বাবদ আগেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ৩৫ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়।

শিমুলের স্বজনরা বলেন, কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই ডা. জাহীর আল আমীন তাৎক্ষণিক আত্মগোপনে চলে যান। পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই চিকিৎসককে অজ্ঞাত জায়গা থেকে বের করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে।

ভুল চিকিৎসার পাশাপাশি ডা. জাহীরের বিরুদ্ধে মদ্যপ অব্যস্থায় চিকিৎসা দেওয়ার অভিযোগও করেছেন ভুক্তভোগীরা। তারা বলেছেন, ডা. জাহীর ও ডা. ইফতেখার অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করার আগে মদ্যপ ছিলেন বলে স্পষ্টই মনে হয়েছে।

মৃত শিমুলের স্ত্রী সায়মা সুলতানা বলেন, ‘আমার স্বামী একজন সুস্থ-সবল মানুষ। সেফটোপ্লাস্টি সার্জারির মতো এমন একটি ছোট সার্জারি করে আমার স্বামীকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, আমার স্বামী পৃথিবীতে নেই। আমার দুটি সন্তান। ওরা কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা যাচ্ছে। আমার দুই সন্তানকে আমি কী বলে সান্ত্বনা দেব? আমাদের সব শেষ। আমি আমার স্বামীর হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।’

এ বিষয়ে কথা বলতে গতকাল একাধিকবার ডা. জাহীরের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ধরেননি। হোয়াটসঅ্যাপে এসএমএস করেও সাড়া মেলেনি।

কলাবাগান থানার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই জয়নাল আমাদের সময়কে বলেন, আমরা মামলা নিয়েছি। গত বুধবার রাতেই অভিযুক্ত ডাক্তারসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আজ (গতকাল বৃহস্পতিবার) আদালতে তোলা হলে বিচারক তাদের জামিন দেন। তিনি বলেন, আমরা জানতে পেরেছি, এর আগেও এই চিকিৎসক ভুল চিকিৎসা দিয়ে শাস্তি ভোগ করেছেন।

এদিকে শিমুলের মৃত্যুতে নিজেদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে কমফোর্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) সেলিম সরকার গত রাতে আমাদের সময়কে বলেন, এ ঘটনার সম্পূর্ণ দায় চিকিৎসকের, আমাদের নয়। একটি সাধারণ অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে এমন ঘটনা ঘটবে কেউই বুঝতে পারিনি। আমি জেনেছি অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হলে রোগীর সঙ্গে কথাও বলেন সার্জন। কিন্তু পোস্ট অপারেটিভ রুমে নেওয়ার সময় রোগী হার্ট অ্যাটাক করেন। আমাদের সুযোগ-সুবিধার অভাব ছিল না। ডাক্তার ভুল কিছু করে থাকলে সেই দায় তারই। তিনি আরও বলেন, ডা. জাহীর তার নিজস্ব টিম দিয়ে অস্ত্রোপচার করেন। এমনকি অ্যানেস্থেসিস্ট পর্যন্ত তার নিজের আনা। সেখানে অবহেলা কিংবা ত্রুটি কিছু হয়ে থাকলে সেই দায়ভার তো আমাদের নয়।

এর আগেও ২০২২ সালে ডা. জাহীরের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসা করার অভিযোগ উঠেছিল। এক নারীর তার কাছে কানের সার্জারি করতে গিয়ে ভুল চিকিৎসার শিকার হন। প্রায় এক বছর তদন্ত করে চিকিৎসায় অবহেলা ও গাফিলতির প্রমাণ পায় বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। পরে এক বছরের জন্য নিবন্ধন স্থগিত করা হয়।