এমপি স্টিকার সাঁটা গাড়িতে চলত বদির ইয়াবা পাচার
হত্যাচেষ্টা মামলায় কারাগারে
মিয়ানমার থেকে মরণনেশা ইয়াবা টেকনাফে আসার পর এমপির স্টিকার সাঁটা আবদুর রহমান বদির গাড়িতে করে তা পাচার করা হতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা ওই গাড়ি তল্লাশির সাহস পেতেন না। বিষয়টি তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও অবহিত করেছিলেন। বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমেও এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। কিন্তু এসবে কোনো কাজই হয়নি। ফলে দিন দিন বিস্তার লাভ করে বদির ইয়াবা কারবার। সাবেক এই এমপির নেপথ্য মদদে তার নিকটজনদের মধ্যে তো বটেই, টেকনাফের ঘরে ঘরে তৈরি হয় ইয়াবা কারবারি।
সর্বশেষ, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর করা একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার বদিকে গতকাল আদালতে তোলা হলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ২০০৬ সালের পর থেকে দেশের গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে বলা হয়,
মিয়ানমার থেকে মরণনেশা ইয়াবা আসছে বাংলাদেশে। ২০০৯ সালের শুরুতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইয়াবার পাচার আরও অনেক বেড়ে যায়। এ কারবারের প্রধান হোতা হয়ে ওঠেন স্থানীয় এমপি আবদুর রহমান বদি ও তার পরিবারের সদস্যরা। ওই সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্থানীয় কর্মকর্তারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছিলেন, বদির সংসদ সদস্য স্টিকার সাঁটা গাড়িতে করেই ইয়াবা আনা হয় টেকনাফ থেকে। সেই গাড়ি তল্লাশি করার সাধ্য তাদের নেই। এমন অবাধ সুযোগ পেয়ে বদির মদদে টেকনাফের ঘরে ঘরে তৈরি হয় ইয়াবা কারবারি। ক্রমান্বয়ে তা কক্সবাজার জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ২০১৮ সালের মে মাসের মাঝামাঝি মাদকের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে শুরু হয় সরকারের অভিযান। এর কয়েক মাস পর সাজানো হয় ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণের নাটক। কক্সবাজার জেলায় ১ হাজার ১৫০ জন তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি থেকে মাত্র ১০২ জন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের কাছে আত্মসমর্পণ করেন টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। জমা দেওয়া হয় ৩ লাখ ইয়াবা, সঙ্গে কিছু অস্ত্রও। এ তালিকায় বদির চার ভাইসহ আত্মীয়রাও ছিলেন, যারা সাধারণ ক্ষমা পেয়ে সাফ-সুতরো হয়ে কিছুদিনের মধ্যেই নতুন করে ইয়াবা কারবারে নেমে পড়েন। এমনকি ওই তালিকার একাধিক ব্যক্তি পরবর্তীতে ইয়াবাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরাও পড়েন।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বদির ভাই মাওলানা আবদুস শুক্কুর, শফিকুল ইসলাম, আমিনুর রহমান ও ফয়সাল রহমানও আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত তার অপর ভাই ওয়ার্ড কাউন্সিলর মুজিবুর রহমান ওই সময় আত্মসমর্পণ করেননি। আত্মসমর্পণ করা বদির অন্য আত্মীয়রা হলেনÑ ভাগিনা সাহেদ রহমান নীপু, ফুফাতো ভাই কামরুল হাসান রাসেল, খালাতো ভাই মংমং সেন ও বেয়াই শাহেদ কামাল ও আক্তার কামাল। এর বাইরে বদির এক সময়ের ডান হাত বলে পরিচিত তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি টেকনাফ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহমদের ছেলে দিদার মিয়াও আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
বদির মামা হায়দার আলীও একজন তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি যিনি আত্মসমর্পণ করেননি। এর বাইরে ইয়াবা কারবারি বদির বোনজামাই মোহাম্মদ ফারুক, বাহাদুর, মোহাম্মদ শফিক, গফুর আলম ও আবদুল হাফেজ আত্মসমর্পণ করেননি। এদের মধ্যে মোহাম্মদ ফারুক হুন্ডি ব্যবসা, ইয়াবা কারবার ও স্বর্ণ চোরাচলানের মাধ্যমে শত কোটি টাকার মালিক বনে যান।
আবদুর রহমান বদি টেকনাফ পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান। ২০০৮ সালে কক্সবাজারের-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য হন। কিন্তু বদি, তার আত্মীয়স্বজন ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে ইয়াবা কারবারের অভিযোগ উঠলে ২০১৮ ও ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে বদির স্ত্রী শাহীন আক্তারকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। যদিও বদির স্ত্রী শাহীন সংসদ সদস্য ছিলেন স্রেফ কাগজে-কলমে। বাস্তবে সব সামলেছেন বদি নিজেই।
আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৬ বছরের শাসনামলে শুধু ইয়াবা পাচারের গডফাদার হিসেবেই নয়, শিক্ষক, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের মারধরসহ নানা অপকর্মের কারণে বারবার আলোচনায় আসেন আবদুর রহমান বদি। জড়িয়ে পড়েন টেন্ডারবাজি, জমি দখল ও চাঁদাবাজির সঙ্গেও। টেকনাফ সমুদ্র উপকূলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মানব পাচার চক্রেরও প্রধান আশ্রয়দাতা হয়ে উঠেন বদি, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে আসা রোহিঙ্গারা আশ্রয়-প্রশ্রয় পেতে থাকেন তার কাছে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অপরাধে বদির বিরুদ্ধে আছে দুদকের মামলা।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
আবদুর রহমান বদিকে গ্রেপ্তারের খবরে কক্সবাজার জেলা সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, আবদুর রহমান বদির নামে ইয়াবা পাচারসহ নানা অভিযোগ ছিল সবসময়। আমরা গণমাধ্যম থেকে জেনেছি মাদক পাচারের বিভিন্ন তালিকায় তার নাম ছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তিনি বলেন, আমাদের অসুস্থ রাজনীতির পরিণতি হলো এই গ্রেপ্তার। রাজনীতি সুস্থ থাকলে আজকে এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটত না।
হত্যাচেষ্টা মামলায় কারাগারে
টেকনাফের একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় বদিকে গত মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ের একটি বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। গতকাল বুধবার সকালে তাকে কক্সবাজারের আদালতে তোলা হয়। বিচারক হামিমুন তানজিন তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
আদালতে উপস্থিত আইনজীবী মোহাম্মদ শাহীন জানান, টেকনাফ থানার তদন্ত কর্মকর্তা বদিকে রিমান্ডে নেওয়ার একটি আবেদন পাঠানো হচ্ছে বলে আদালতকে অবহিত করেন। কিন্তু আবেদনটি আদালতে না পৌঁছায় বদিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন বিচারক। টেকনাফ থানার ওসি মুহাম্মদ ওসমান গণি জানান, গত ১৯ আগস্ট কক্সবাজার জেলা বিএনপির অর্থ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, তার ভাই টেকনাফ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান জিহাদ, অপর ভাই আবদুর রহমান পৃথক তিনটি মামলা করেন বদির বিরুদ্ধে।
গত ১৮ আগস্ট কক্সবাজার জেলা বিএনপির অর্থ সম্পাদক টেকনাফের মো. আবদুল্লাহ বাদী হয়ে আবদুর রহমান বদিকে ১ নম্বর আসামি করে ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে ও ৫০-৬০ জন অজ্ঞাতনামাকে আসামি করে টেকনাফ থানায় মামলা করেন। এ মামলায় বদিকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।