নতুন বাংলাদেশ দেখা হলো না তাদের

আজাদুল আদনান
১৯ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
নতুন বাংলাদেশ দেখা হলো না তাদের

রহমাতুল্লাহ সরদার (সাব্বির)। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বরিশালের অন্যতম সমন্বয়ক তিনি। তিন ভাইকে এতিম করে ২০ বছর আগে মারা যান তার বাবা। পরিবারের মেজো সন্তান সাব্বির। তার বড় ভাই থাকলেও এখন বেকার। তাই টিউশনি করে অসুস্থ মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে পরিবারের হাল ধরেছেন সাব্বির। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে তিনি পুলিশের গুলিতে এক চোখ হারিয়েছেন, অন্য চোখেও দেখা দিয়েছে গুরুতর দৃষ্টি স্বল্পতা। এখনো চোখে গুলি বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। এতে সাব্বিরের জীবনের পাশাপাশি অন্ধকার নেমে এসেছে তার পরিবারেও। আন্দোলনে সফলতা পেলেও নতুন বাংলাদেশ দেখা হয়নি সাব্বিরের। তার মতো এ রকম চোখে রাবার বুলেট কিংবা ছররা গুলি লাগা অনেকেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, যাদের নতুন বাংলাদেশ দেখা হয়নি। আদৌ তারা চোখের আলো ফিরে পাবেন কিনা, সেই উদ্বেগ আহতদের।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে গত ৪ আগস্ট বরিশাল বিএম কলেজ-সিএনবি চৌমাথার সামনে আন্দোলনকালে পুলিশের ছররা গুলিতে আহত হন সাব্বির। শুরুতে স্থানীয় হাসপাতালে এবং পরে রাজধানীর জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে আনা হয় তাকে। বর্তমানে সেখানেই চিকিৎসাধীন তিনি। বিএমএম কলেজের সাবেক এই শিক্ষার্থী বর্তমানে বরিশাল ল কলেজে পড়ছেন।

গতকাল চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে গিয়ে দেখা যায়, সাব্বিরের শয্যার পাশে বাংলাদেশের পতাকা। কণ্ঠে নেই কোনো আফসোস। সাব্বির বিশ^াস করেন, সংস্কার হওয়া বাংলাদেশ তিনি দেখবেন। আমাদের সময়কে সাব্বির বলেন, বাবা নেই, মা-ও অসুস্থ। বড় ভাই বেকার, ছোট ভাই পড়াশোনা করে। ফলে সব দায়িত্ব আমার ওপরই। টিউশন করে নিজে চলার পাশাপাশি পরিবার চালাতাম। এখন পুরো পরিবারই সাগরে পড়ে গেছি। তবে আফসোস নেই। নতুন বাংলাদেশ হয়েছে, সেটাই বড় পাওয়া।

শুধু সাব্বির নন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সারাদেশে পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেট ও ছররা গুলিতে সহস্রাধিক মানুষ চোখে আঘাতপ্রাপ্ত হন। তবে প্রকৃত সংখ্যা এখনো জানা যায়নি। রাজধানীর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল ও জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় সহস্র মানুষ। এদের মধ্যে এক চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন ৩৯০ জন। উভয় চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন ২১ জন। গুরুতর দৃষ্টি স্বল্পতা রয়েছে আরও অন্তত ২০০ রোগীর।

হামলা-সহিংসতায় চোখের সমস্যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি রোগী চিকিৎসা নেন চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিউিটে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ১৭ জুলাই থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটিতে ৭৪০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ভর্তি করা হয় ৬১০ জনকে। তাদের মধ্যে অস্ত্রোপচার করা হয় ৪৯৫ জনের। এক চোখ হারিয়েছেন ৩৬৬ জন। আর দুই চোখ হারিয়েছেন ১৭ জন। এ ছাড়া গুরুতর দৃষ্টি স্বল্পতায় ভুগছেন ৩৮ জন, কম দৃষ্টি স্বল্পতা ১৫৮ জনের।

গতকাল চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ৫ম তলার ৫০৪নং ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, বি-২৬ নম্বর শয্যায় ক্যানুলা হাতে শুয়ে আছে ১০ বছরে শিশু জেমরান। তার বাঁ চোখের পাপড়ি, কান, মুখ ও শরীরের বিভিন্ন অংশে ছররা গুলির চিহ্ন দেখা যায়।

জেমরানের মা পান্না বেগম জানান, পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার এলাকার গলির মুখে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করছিল একমাত্র ছেলেটি। এ সময় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ চলছিল। হঠাৎ পুলিশের ছররা গুলি এসে লাগে জেমরানের চোখে-মুখে। স্থানীয়রা তাকে ঢামেক হাসপাতলে নিয়ে যায়।

চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা আমাদের সময়কে বলেন, আন্দোলনের শুরুর দিকে রোগী কম থাকলেও ক্রমেই বাড়তে থাকে। জুলাইয়ে ৪৪৫ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। আর আগস্টে নিয়েছে ২৯৫ জন। এর মধ্যে বহু রোগী দুই চোখের আলো হারিয়েছেন। বর্তমানে ৪২ জন চিকিৎসাধীন।

কতজন চোখের দৃষ্টি ফিরে পাবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। প্রকৃত সংখ্যা আরও দু-তিনটি সার্জারি করলে বোঝা যাবে। তবে এখন পর্যন্ত ৩৬৬ জনের এক চোখের দৃষ্টি না ফেরাটা নিশ্চিত। আর উভয় চোখের দৃষ্টি হারানোর সংখ্যা এখন পর্যন্ত ১৭ জন।

এদিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের চক্ষু বিভাগে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৫০ জনের বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ৫২ জনের অস্ত্রোপচার হয়েছে। তাদের মধ্যে ইতোমধ্যে এক চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন ২৪ জন ও উভয় চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন চারজন। চিকিৎসকরা বলেছেন, অন্তত আরও অর্ধশত রোগী দৃষ্টিশক্তি হারানোর আশঙ্কায় রয়েছেন।

ঢামেক হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. আল মাহমুদ লেমন বলেন, রাবার বুলেটে শত শত মানুষ দৃষ্টি হারিয়েছে। অধিকাংশের এক চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অনেকের দুই চোখই নষ্ট হয়ে গেছে। যাদের অধিকাংশই তরুণ কিংবা কিশোর, ১০ বছরের নিচে কয়েজনও ছিল। চোখের পাতায় আঘাত লাগলে সাধারণত দৃষ্টিশক্তি হারায় না। তবে আইবলে আঘাত পেলে দৃষ্টিশক্তি হারানোর ঝুঁকি বেশি থাকে।

চক্ষু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আশরাফ সায়েদ আমাদের সময়কে বলেন, যেসব রোগী এখানে দ্রুত আনা গেছে, তাদের তেমন সমস্যা হয়নি। কিন্তু যাদের বিলম্বে আনা হয়েছে তাদের বেশি সমস্যা। চোখে ঢুকে থাকা আয়রণ বের করলেও সেটির প্রভাব থেকে যায়। যত বেশি এটি চোখের ভেতর থাকবে, ততই বিপদ। পাশাপাশি দ্রুত চিকিৎসা শুরু করাটাও গুরুত্বপূর্ণ বলেও জানান এই চিকিৎসক।