কৃষিভিত্তিক শিল্পের ঋণেও ছন্দপতন

জিয়াদুল ইসলাম
১৯ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
কৃষিভিত্তিক শিল্পের ঋণেও ছন্দপতন

ঢাকার চকবাজারে আলাউদ্দিন এগ্রো ফুড প্রোডাক্টস নামে একটি বেকারির কারখানা রয়েছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা মারুফ আহমেদের। সেই কারখানা সম্প্রসারণে দুই বছরের অধিক সময় বিভিন্ন ব্যাংকে ঘোরাঘুরির পর চলতি বছর পূবালী ব্যাংক থেকে দেড় কোটি টাকার ঋণ পেয়েছেন। তার অভিযোগ, নতুন গ্রাহক হওয়ায় প্রথম সারির অন্তত তিনটি ব্যাংক তাকে ঋণ দিতে রাজি হয়নি। মারুফ আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, রপ্তানি করতে ব্যবসার টার্নওভার বড় করার দরকার ছিল। এ জন্য ঋণের জন্য ব্র্যাক ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকে দীর্ঘদিন ঘুরেছি। নতুন গ্রাহক হওয়ার কারণে ব্যাংকগুলো আমাকে মূল্যায়ন করেনি।

এ শিল্পের অধিকাংশ ক্ষুদ্র ও নতুন উদ্যোক্তাদের অভিযোগ মারুফের মতোই। চলমান ডলার সংকট ও দাম বৃদ্ধি, উচ্চ সুদের হার এবং রপ্তানিতে নগদ সহায়তা কমানোর ফলে সম্প্রতি এ শিল্পে বিনিয়োগের আগ্রহ কমেছে অনেকের। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমুখী নীতি, তারল্য সংকট ও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলোও অর্থায়ন কমিয়ে দিয়েছে। ফলে কৃষিভিত্তিক শিল্পে টানা বাড়তে থাকা ঋণের প্রবাহে হঠাৎ ছন্দপতন হয়েছে। চলতি বছর প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) ঋণ কমে গেছে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত মার্চ পর্যন্ত কৃষিভিত্তিক শিল্পে ব্যাংকগুলোর ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে প্রায় ১১ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা।

কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প কৃষি খাতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ যতটা এগিয়েছে, প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে ততটা নয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণের অভাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর মোট উৎপাদনের ৩০ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে জিডিপিতে কৃষি কাক্সিক্ষত অবদান রাখছে পারছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জিডিপিতে অবদান বাড়াতে বাণিজ্যিক কৃষির বিকল্প নেই। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ হলো বাণিজ্যিক কৃষির মূল চালিকাশক্তি। দেশে-বিদেশে কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বিশে^র ১৫০টি দেশে কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। কিন্তু পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও অর্থায়নের অভাবে এর বিকাশ আশানুরূপ হচ্ছে না। বরং সুযোগ-সুবিধা কমানোয় সংকট বেড়েছে। তাই এ খাতের বিকাশ ও নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণে স্বল্প সুদের মূলধন সহায়তার পাশাপাশি রপ্তানিতে নগদ সহায়তা বৃদ্ধি এবং শুল্কমুক্ত সুবিধায় মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দিতে হবে।

বাংলাদেশ এগ্রো-প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ইকতাদুল হক আমাদের সময়কে বলেন, কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে আগে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা মিললেও এখন ১০ শতাংশে নামানো হয়েছে, যা এ খাতের জন্য বড় দুঃসংবাদ। এতে বিশ্ববাজারে আমাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে গেছে। সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঘটনায় আমরা আরও ক্ষতির মুখে পড়েছি। এখন ১৫ শতাংশের কম সুদে ব্যাংকঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। ডলার সংকটে কনটেইনার ভাড়া ও কাঁচামালের দাম বেড়েছে। সব মিলিয়ে আমরা ভালো নেই। ব্যবসা করে আগের ঋণ পরিশোধ করাই অনেকের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে।

এ খাতের বিকাশে দুই বছর আগে কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা করেছে সরকার। নীতিমালায় বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য নতুন ও পুরনো শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন ধাপের উন্নয়নে নামমাত্র সুদে মূলধন সহায়তা, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানিতে শুল্ক অব্যাহতি, গবেষণায় প্রণোদনা, পরীক্ষাগার তৈরিতে অনুদান, আয়কর মওকুফ, দক্ষ কর্মী তৈরিসহ বিভিন্ন প্রণোদনা প্রদান করার কথা বলা হলেও তার বাস্তবায়ন নেই। পূর্বাশা অর্গানিক ফুড অ্যান্ড বেভারেজের চেয়ারম্যান মো. বশির উল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, সম্ভাবনা থাকলেও খাতটির বিকাশে যেসব সহযোগিতা দরকার তা নেই। বরং বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা কমানো হয়েছে। ফলে আমাদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে।

মোট ঋণ পরিস্থিতি : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চে তা কমে দাঁড়ায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। ফলে তিন মাসের ব্যবধানে ঋণ কমেছে প্রায় ১ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে গত বছরের মার্চ পর্যন্ত ঋণস্থিতি ছিল ১ লাখ ২ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। ফলে এক বছরের ব্যবধানে ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৭ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা বা ১৭ শতাংশ। আর গত বছরের পুরো সময়ে ঋণ বেড়েছিল ১৮ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা বা ১৮.৩০ শতাংশ। তার আগের বছর ঋণ বৃদ্ধির হার আরও বেশি, প্রায় ২৭ শতাংশ।

প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা আমাদের সময়কে বলেন, এ শিল্পে ঋণ কমার মূল কারণ বৈদেশিক মুদ্রার সংকট। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর যখন বৈদেশিক মুদ্রার ক্রাইসিস শুরু হয়, তখন থেকে প্রায় সব খাতেই মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি খোলা কমে গেছে। কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প তার বাইরে নয়। তার মতে, ডলার সংকট, ব্যাংক ঋণের সুদহার বৃদ্ধি ও রপ্তানিতে নগদ সহায়তা হ্রাস শিল্পটির বিকাশ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (তখনকার ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, আগের ঋণ পরিশোধ ও নতুন করে ঋণ না দেওয়ার কারণে ওই তিন মাসে ঋণের স্থিতি কমতে পারে। তবে বছরের ব্যবধানে ঋণের স্থিতি কমেনি, ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। প্রতি ত্রৈমাসিকে সমান হারে ঋণ বিতরণ বাড়বে- এটা সবসময় নাও হতে পারে। পুরো বছরে ঋণ বিতরণ না বাড়লে চিন্তার বিষয় ছিল। এ ক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি।

বড়দের ঋণ ও বিনিয়োগ বেশি : কৃষিপণ্যের সহজলভ্যতার কারণে দেশের বড় বড় করপোরেট ব্যবসায়ীরা এ খাতে বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ করেছেন। এসব বিনিয়োগের উল্লেখযোগ্য অংশই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে করা হয়েছে। এ খাতে ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ৮০ শতাংশই বড় গ্রাহকদের কাছে কেন্দ্রীভূত। বাপার তথ্য বলছে, কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাতের প্রায় ৬০০ প্রতিষ্ঠান তাদের সদস্য। এর মধ্যে প্রায় অর্ধশত প্রতিষ্ঠান বড় গ্রুপগুলোর, যারা বিনিয়োগ ও রপ্তানিতে এগিয়ে রয়েছে। এ তালিকায় সবার শীর্ষে আছে প্রাণ গ্রুপ। এ ছাড়া স্কয়ার, এসিআই, মেঘনা, সিটি, বসুন্ধরা, আবুল খায়ের, ইস্পাহানি, টি কে, এলিন, আকিজ ও সামুদা গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে এ শিল্পে সর্বোচ্চ ঋণ রয়েছে সোনালী ব্যাংকের। গত জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম আমাদের সময়কে বলেন, সোনালী ব্যাংক এ খাতে ঋণ বিতরণে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এ কারণে ঋণ বিতরণ আশানুরূপ বেড়েছে। শুধু কৃষিভিত্তিক শিল্প নয়, সার্বিক সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণে বেশ উন্নতি হয়েছে। দুই বছর আগেও সিএমএসএমইতে আমাদের ঋণ ছিল টোটাল পোর্টফলিওর সাড়ে ৭ শতাংশ, এখন সেটি ১৬ শতাংশে পৌঁছেছে।

ক্ষুদ্র ও নতুনদের ঋণ দিতে অনাগ্রহ : নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জে চৌমুহনীর বিসিক শিল্প এলাকায় একটি মুড়ি কারখানা করতে অগ্রণী ও ইসলামী ব্যাংকে দেড় কোটি টাকার ঋণের আবেদন করেছিলেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ওয়ালিউল্লাহ হারুন। এ জন্য তার সব জায়গাজমি মর্টগেজ করতে রাজি ছিলেন, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা। ওয়ালিউল্লাহ হারুন আমাদের সময়কে বলেন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হওয়ার কারণে ব্যাংক দুটি আমাকে ঋণ দিতে রাজি হয়নি। তাদের কথাবার্তা এ রকম যে আমি ঋণ পাওয়ার যোগ্যতাই রাখি না। আরেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা কুমিল্লার দেবিদ্বারের আরএস ফুডস প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রির স্বত্বাধিকারী আশরাফুজ্জামান খন্দকার বলেন, আমরা ব্যাংকগুলোতে ঋণের জন্য গেলে খুব কড়াকড়ি ও বিভিন্ন রকমের হয়রানি করে।

পুনঃঅর্থায়ন ঋণ বিতরণেও গতি কম : মফস্বলভিক্তিক শিল্প স্থাপনে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল রয়েছে। ২০০১ সালের ১২ নভেম্বর ১৫০ কোটি টাকা নিয়ে ওই তহবিল যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীকালে তা ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। চলতি বছর ৩১ মে পর্যন্ত এই তহবিল থেকে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে ৩ হাজার ৯১ কোটি টাকা পুনঃঅর্থায়ন করা হয়। অর্থাৎ গড়ে প্রতিবছর মাত্র ২৪৭ কোটি টাকা করে বিতরণ করা হয়েছে।

বাড়ছে খেলাপি ঋণ : করোনার ধাক্কা সামলে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশের ব্যবসাবাণিজ্যের ওপর পড়ে। এতে কৃষিভিত্তিক শিল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে অনেকেই সময়মতো ব্যাংকের ঋণ ফেরত দিতে পারেননি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছর মার্চ শেষে এ খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা। গত বছর মার্চ পর্যন্ত এর পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা। আর গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল ১০ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা। ফলে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২ হাজার ১৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সর্বশেষ তিন মাসে বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ২৮ কোটি টাকা।